প্রতীকী ছবি।
অতিমারিকে পিছনে ফেলে দুনিয়ার মানুষ এগিয়ে যেতে পারবে কি না, সেই প্রশ্ন সঙ্গে নিয়ে ২০২২ সালের আগমন হয়েছিল। আজ সে প্রশ্ন রেখে যাচ্ছে, বিপদ কি নতুন উদ্যমে ফিরে আসবে? বছরের শেষ পর্বে চিনে— সেই চিনে— বিপুল সংক্রমণের সংবাদে ঘরপোড়া দুনিয়ার আতঙ্ক অহেতুক নয়। তবে আশা এই যে, অধিকাংশ বিশ্ববাসী ইতিমধ্যে প্রতিরোধী ক্ষমতা সংগ্রহ করেছেন, সুতরাং সংক্রমণ ঘটতে থাকলেও অতিমারির রুদ্রমূর্তি ফিরবে না। আপাতত সতর্কতা জরুরি, আতঙ্ক নয়। হাল-ভাঙা পাল-ছেঁড়া বিশ্ব অর্থনীতিও সেই দাবিই জানাচ্ছে। অতিমারির অভূতপূর্ব অভিঘাত সামলে এই বছরটিতে সমে ফিরতে চেয়েছে সে। কিন্তু সেই প্রক্রিয়ায় এক বিরাট ধাক্কা দিয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত, যা এখনও অব্যাহত। এই পরিপ্রেক্ষিতেই বিশ্ব জুড়ে, বিশেষত পশ্চিম দুনিয়ায় চলছে মূল্যস্ফীতি এবং মন্দার সাঁড়াশি আক্রমণ। তার পাশাপাশি আছে প্রকৃতি-পরিবেশের দুর্বার অবক্ষয়। মিশরে জলবায়ু বিষয়ক বার্ষিক সম্মেলনে রাষ্ট্রনায়কেরা এই ক্ষয় রোধের পথে এগিয়েছেন বটে, তবে বড়জোর আড়াই পা। সামগ্রিক ভাবেই ২০২২ সাল দেখিয়ে দিল, অতিমারির বিপর্যয়ও দুনিয়াদারদের সম্বিৎ ফেরাতে পারেনি, ক্ষুদ্র এবং স্বল্পমেয়াদি স্বার্থের নির্দেশেই তাঁদের রাষ্ট্রনীতি, অর্থনীতি এবং কূটনীতি পথ চলছে। সর্বনাশের পথ।
এই প্রেক্ষাপটে ভারতের অভিজ্ঞতাকে স্থিতিশীল বললে ভুল হবে না। দক্ষিণ এশিয়ায় তো বটেই, বৃহত্তর বিশ্বেও এ দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি উপরের সারিতে। তার পিছনে সরকারের কৃতিত্ব অবশ্য যৎসামান্য, সুচিন্তিত কোনও আর্থিক নীতি তাঁদের চিন্তার ত্রিসীমানায় নেই, সাঙাততন্ত্রের সাধনা ভিন্ন তাঁরা দৃশ্যত কিছুই বোঝেন না। ভারতীয় অর্থনীতি তার নিজস্ব শক্তিতেই চলছে। তুলনায় কিছুটা দক্ষতার পরিচয় মিলেছে বিদেশনীতিতে, বিশেষত ইউক্রেন যুদ্ধের প্রতিক্রিয়া সামলানোর ব্যাপারে। এক দিকে শান্তি ও সুস্থিতির নৈতিক দাবি, অন্য দিকে জাতীয় স্বার্থের— বিশেষত জ্বালানির প্রয়োজন মেটানোর— বাস্তব চাহিদা, এই দুইয়ের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে চলার কঠিন কাজে সাউথ ব্লক এই অবধি কৃতিত্ব দাবি করতে পারে। কিন্তু এই স্থিতি এবং কৃতির পাশেই জেগে থাকে একাধিক প্রশ্ন ও উদ্বেগ। চিন-সমস্যা ক্রমশই সঙ্কটের রূপ নিচ্ছে, যে সঙ্কটের মোকাবিলায় কঠোরতা এবং বুদ্ধিমত্তার প্রয়োজনীয় সমন্বয় এ পর্যন্ত দেখা যায়নি, তার বদলে প্রকট হয়েছে প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর পারিষদদের পলায়নি নীরবতা অথবা অন্তঃসারশূন্য বাগাড়ম্বর।
অন্য দিকে, দেশের ভিতরে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির একচ্ছত্র শাসন কায়েম করার প্রকল্প উত্তরোত্তর জোরদার হচ্ছে, অযোধ্যা থেকে তার অশ্বমেধের ঘোড়া ছুটছে কাশী মথুরার পথে। সমান্তরাল গতিতে চলেছে রাজ্যগুলিকে ছলে বলে কৌশলে এককেন্দ্রিক আধিপত্যের বলয়ে নিয়ে আসার তৎপরতা। ভারতীয় গণতন্ত্র ক্রমশ পরিণত হচ্ছে সংখ্যাগুরুবাদের লীলাভূমিতে। এই বিপদকে প্রতিহত করতে প্রয়োজন উদার গণতান্ত্রিক সামাজিক ও রাজনৈতিক শক্তিগুলির সম্মিলিত প্রতিরোধ, বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রীয় আদর্শের প্রেরণায় রাজ্য স্তরে যথার্থ গণতন্ত্রের অনুশীলন। কিন্তু অধিকাংশ রাজ্যেই সেই প্রয়োজন পূরণের সম্ভাবনা সুদূরপরাহত। পশ্চিমবঙ্গ তার ব্যতিক্রম নয়। এই রাজ্যের শাসকেরা থেকে থেকে কেন্দ্রবিরোধী আওয়াজ তোলেন, কিন্তু তা ক্রমশই শূন্যকুম্ভের গর্জন বলে ধরা পড়ে যাচ্ছে। হয়তো সেটাই অনিবার্য— তাঁদের প্রায় এক যুগের শাসনে রাজ্যের অর্থনীতি, সমাজ এবং রাজনীতি যে ভয়াবহ রকমের পূতিগন্ধময় পঙ্কস্তূপে নিমজ্জিত হয়েছে, সেই পাঁক ঘাঁটতে ঘাঁটতেই একটা গোটা বছর শেষ হয়ে গেল। আগামী বছর উত্তরণের পথ খুঁজে পাবে কি? কে খুঁজবে সেই পথ?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy