Advertisement
১২ জানুয়ারি ২০২৫

দম্ভসৌধ

শুধু নূতন সংসদ ভবন নির্মাণেই ব্যয় ধরা হইয়াছে ৯৭১ কোটি টাকা। বিশেষজ্ঞরা বলিতেছেন, ২০০ কোটি টাকায় ১৬০টিরও বেশি অক্সিজেন প্ল্যান্ট তৈরি করা যায়

শেষ আপডেট: ০৪ মে ২০২১ ০৫:৪৯
Share: Save:

রোম যখন পুড়িতেছিল, শুনা যায়, সম্রাট নিরো তখন বেহালা বাজাইতেছিলেন। আজ আর শোনা কথা নহে, দিবালোকের ন্যায় প্রকাশ্য— দিল্লি যখন অতিমারিতে ধুঁকিতেছে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ‘সেন্ট্রাল ভিস্টা’ প্রকল্পে নূতন সংসদ ভবন নির্মাণ ও দিল্লির রাজপথের দুই পাশের এলাকা ভাঙিয়াচুরিয়া নূতন করিয়া সাজাইতে ঢালাও ব্যবস্থা করিতেছেন। এমন এক সময়ে, যখন দিল্লির হাসপাতালে বেড নাই, অক্সিজেনের সিলিন্ডার নাই, শ্মশানে ঠাঁই নাই, অন্য দিকে দীর্ঘায়িত লকডাউনে রাজধানীর জনজীবন হইতে কর্মক্ষেত্র স্তব্ধ। কিন্তু সেন্ট্রাল ভিস্টা প্রকল্পের কাজ হইয়া উঠিয়াছে ‘অত্যাবশ্যক পরিষেবা’। কর্মীদের কাজ চলিতেছে তিন শিফটে, কার্ফুর মধ্যেও প্রকল্পের জন্য ১৮০টি গাড়ি চলিবার অনুমতি মিলিয়াছে। কারণ, এই বৎসরের নভেম্বরের মধ্যে কাজ শেষ করিতেই হইবে।

রাজধানীর ভাঙিয়া পড়া স্বাস্থ্যব্যবস্থা, অসহায় নাগরিকের মৃত্যুর করুণ চিত্র দেখিয়া যখন বিশ্ববাসী শিহরিয়া উঠিতেছেন, তখন বিশ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে সেন্ট্রাল ভিস্টা প্রকল্পের কাজ চালাইয়া যাইবার সিদ্ধান্তটি শুধু দুর্ভাগ্যজনকই নহে, মানবিকতারও পরিপন্থী। শুধু নূতন সংসদ ভবন নির্মাণেই ব্যয় ধরা হইয়াছে ৯৭১ কোটি টাকা। বিশেষজ্ঞরা বলিতেছেন, ২০০ কোটি টাকায় ১৬০টিরও বেশি অক্সিজেন প্ল্যান্ট তৈরি করা যায়, মৃত্যু আর হাহাকারের এই রাজধানীতে সেই নূতন ভবনের অর্থ অক্সিজেন বরাদ্দে দিলে অগণন মানুষ শ্বাস লইয়া বাঁচিতে পারিতেন। হিসাব কষিয়া দেখা গিয়াছে, কেন্দ্রীয় সরকার দেশের ১৮ হইতে ৪৪ বৎসর বয়সি মানুষদের ৭০ শতাংশকেও বিনামূল্যে টিকা দিবার সিদ্ধান্ত নিলে তাহাতে ২০ হইতে ২৬ হাজার কোটি টাকার বেশি লাগিত না। অথচ রাজ্যবাসীর কোভিড-টিকার ভার কেন্দ্র রাজ্যের উপরেই চাপাইয়া নিজে হাত ধুইয়া ফেলিয়াছে। এই ক্রান্তিকালে প্রধানমন্ত্রী ও তাঁহার সরকারের কাছে সেন্ট্রাল ভিস্টা প্রকল্পই অত্যাবশ্যক হইল, যে অর্থে তিনি প্রকল্প গড়িতেছেন তাহা যে জনগণেরই অর্থ তাহা জানিয়া-বুঝিয়াও তিনি তাহা জনগণের প্রাণরক্ষায় কাজে লাগাইলেন না। অতিমারি এক দিন চলিয়া যাইবে, প্রকল্পও শেষ হইবে, সেন্ট্রাল ভিস্টার জমকালো উদ্বোধন হইবে। কিন্তু কোন ক্ষতি আর মৃত্যুস্তূপের উপরে, কোন বিরাট ও করুণ মূল্যে গণতন্ত্রের এই অভিজ্ঞান নির্মিত হইল, দেশবাসী তাহা বিস্মৃত হইতে পারিবেন কি?

অতিমারিকালে প্রধানমন্ত্রী দেশবাসীকে ত্যাগের আহ্বান জানাইয়াছিলেন— সময়, কাজ, জীবনযাত্রা, মানবিক ও সাংস্কৃতিক উচ্ছলতায় মাতিবার প্রবণতা ত্যাগ। আজ ভারত দেখিতেছে, নাগরিকরাই সব ত্যাগ করিলেন— এমনকি প্রাণও— কিন্তু রাষ্ট্রপ্রধান নিজে ত্যাগ স্বীকার করিলেন না। সেন্ট্রাল ভিস্টা তাঁহার স্বপ্নের প্রকল্প, এই কথা বারংবার শুনা গিয়াছে। শুনা গিয়াছে, এই প্রকল্প ভারতের স্বাধীনতার ৭৫ বৎসরে জাতীয় গৌরবফলক। স্বাধীনতার রজত বা সুবর্ণজয়ন্তীতে ইন্দিরা গাঁধী ও ইন্দ্রকুমার গুজরাল বিশেষ সংসদীয় অধিবেশনে বসিয়াছিলেন, ব্যয়কটু হর্ম্য ও রাজপথ বানান নাই। কিন্তু নরেন্দ্র মোদীর স্বপ্ন অন্য ধাতুতে গড়া। তাহাতে লৌহকঠিন দম্ভ আছে, জনসেবী সহানুভূতি নাই। তাই সেন্ট্রাল ভিস্টার কাজ চলিবে। দিল্লি মরিলেই বা কী।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy