Advertisement
২৬ নভেম্বর ২০২৪
WBCPCR

পদাশ্রয়ী

বিভিন্ন কমিশনে নিয়োগের নিয়মরীতি যথেচ্ছ লঙ্ঘন করা, কাজের দাবির সঙ্গে সঙ্গতিহীন নিয়োগ গোড়া থেকেই এক বিপজ্জনক বার্তা দিয়েছে।

রাজ্য শিশু অধিকার সুরক্ষা কমিশন। —ফাইল চিত্র।

রাজ্য শিশু অধিকার সুরক্ষা কমিশন। —ফাইল চিত্র।

শেষ আপডেট: ১০ নভেম্বর ২০২৩ ০৬:০৫
Share: Save:

বিভিন্ন সরকারি কমিশনে বসেন কেবল সরকার ঘনিষ্ঠরাই, এবং কিছু সদস্য একই কমিশনের নানা পদে ঘুরে-ফিরে নিযুক্ত হন, এ হয়তো নতুন তথ্য নয়। তবু এক-এক সময়ে বিষয়টি এতই প্রকট ভাবে সামনে আসে যে, তা এই ‘স্বাভাবিকতা’-কে ছাপিয়ে বিস্মিত করে। এমনই ঘটেছে রাজ্যের শিশু অধিকার সুরক্ষা কমিশনের সদস্যদের পুনর্বহালের বিষয়টিতে। অভিযোগ উঠেছে, নিতান্ত নিষ্ক্রিয় হওয়া সত্ত্বেও কমিশনের বেশ কিছু সদস্য বার বার নিযুক্ত হচ্ছেন। কার্যকালের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরেও কেউ পরামর্শদাতা, কেউ বা উপদেষ্টার পদে থেকে যাচ্ছেন, বেতন-সহ নানা সুবিধা ভোগ করছেন। শিশু অধিকার সুরক্ষা কমিশনের বর্তমান সদস্যদের মধ্যে বেশ কয়েক জন শাসক দলের (বর্তমান অথবা প্রাক্তন) মন্ত্রী, জনপ্রতিনিধি বা অন্য নেতাদের পরিবারের সদস্য। অস্বীকার করা চলে না যে, ওই সদস্যদের মধ্যে কেউ কেউ নিজের কাজের জন্যও হয়তো সুপরিচিত। কিন্তু সেই পরিচিতিই কি তাঁদের নিয়োগের কারণ? যদি সরকার-পোষিত সংস্থার আসনগুলি কেবলই দখল করেন শাসক-অনুগতরা, তা হলে জনমানসে এমন ধারণা তৈরি হতে বাধ্য যে, নিয়োগের শর্ত আসলে যোগ্যতা নয়, আনুগত্য। এমন স্বার্থদুষ্ট নিয়োগ অপরাধ। অনুগৃহীত ব্যক্তিকে তখন সেই অপরাধের শরিক বলেই বিবেচনা করতে হবে। আক্ষেপ, নাগরিক সমাজের মুখ হিসাবে পরিচিত সমাজকর্মী, সাংস্কৃতিক কর্মীরাও অবলীলায় নানা প্রাতিষ্ঠানিক পদ গ্রহণ করছেন, যেন তা পুরস্কার। প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্যের সঙ্গে নিজের দক্ষতা-অভিজ্ঞতা সামঞ্জস্যপূর্ণ কি না, সে প্রশ্ন কেউ করছেন না।

সদস্যরাই প্রতিষ্ঠানের মুখ, তাঁরা আস্থাভাজন না হলে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলির উপর থেকে ভরসা সরে যায়। মানবাধিকার কমিশন, তথ্যের অধিকার কমিশন, মহিলা কমিশন, সংখ্যালঘু কমিশন প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানের কাজ যে-হেতু গণতন্ত্রে নাগরিকের অধিকারের সুরক্ষা, ফলে সেগুলির সদস্যদের ভাবমূর্তি স্বচ্ছ, উজ্জ্বল হওয়া দরকার। কৃতবিদ্য, সুপরিচিত ব্যক্তিরাও সে কথাটি ভুলে যান। যা হওয়ার কথা ছিল দক্ষতার, উৎকর্ষের প্রতিযোগিতা, তা হয়ে দাঁড়ায় ক্ষমতাসীনের প্রতি প্রকাশ্যে আনুগত্য প্রদর্শনের লড়াই। এই সঙ্কট তৃণমূল আমলে শুরু হয়েছে, এমন নয়। তবে তৃণমূল শাসনের সূচনাতেই তা চোখে পড়েছিল, কারণ ‘পরিবর্তন’-এর সপক্ষে যে বিশিষ্ট নাগরিকরা সরব হয়েছিলেন, তাঁদের অনেকেই নানা কমিশন, কমিটি, পর্ষদ এবং নানা সরকার-পোষিত সংগঠনের পদে নিযুক্ত হয়েছিলেন। অনেক উপদেষ্টারই নিয়োগের ক্ষেত্রটি তাঁর পেশাগত কাজের পরিধি থেকে এতই দূরে অবস্থিত ছিল যে, কী ধরনের ‘উপদেশ’ মিলতে পারে, তা নিয়ে জনমানসে সন্দেহ দেখা দিয়েছিল।

বিভিন্ন কমিশনে নিয়োগের নিয়মরীতি যথেচ্ছ লঙ্ঘন করা, কাজের দাবির সঙ্গে সঙ্গতিহীন নিয়োগ গোড়া থেকেই এক বিপজ্জনক বার্তা দিয়েছে। সরকারি নিয়োগে ক্ষমতাসীনের ইচ্ছাই শেষ কথা, এই ধারণা থেকে নিয়োগ-দুর্নীতির বিষবৃক্ষ দ্রুত ডালপালা ছড়িয়েছে। তার শিকড় কত গভীর, পশ্চিমবঙ্গবাসী প্রতি দিন তা টের পাচ্ছেন। ফলে আরও গাঢ় হচ্ছে একটি ভয়। ইংরেজি প্রবাদবাক্যে বলা হয়, ‘যতই বদল হয়, ততই সব থাকে আগের মতো’। যে দলই পশ্চিমবঙ্গের মসনদে অধিষ্ঠিত হোক, তাতে এই রাজনৈতিক সংস্কৃতির বদল হবে কি? আনুগত্য-কামনার আগ্রাসনে বাম আমলেই ক্ষয়ে আসছিল গণতন্ত্রের পরিসর। এখন নির্ভয় সত্যকথন জনজীবনে যেন আরও বিরল। নারী-হিংসা, নির্বাচনী রক্তপাত-সহ রাজনৈতিক সন্ত্রাস, পর পর অবৈধ বাজি কারখানায় বিস্ফোরণ— কার্যত কোনও ঘটনার পরেই প্রায় কোনও কমিশন জনসমক্ষে বিবৃতি দেয়নি। তৃণমূল সরকারের প্রতি সমালোচনা, বা সতর্কবার্তা উচ্চারণ করেননি কোনও সদস্য। নাগরিকের বিপন্নতায় গণতন্ত্রের প্রহরীদের এই নীরবতা কি অপরাধ নয়?

অন্য বিষয়গুলি:

WBCPCR Politics
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy