Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
BJP

কুশিক্ষার ফাঁদ

মোগল শাসক ও ইসলামি শাসনকে অস্বীকার করা, হিন্দু রাজা-শাসনকর্তাদের বিজয়ী বলে দাগিয়ে দেওয়া আসলে তাদের হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিরই শিক্ষামুখ।

শেষ আপডেট: ১৪ জুলাই ২০২২ ০৫:০০
Share: Save:

নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ তত্ত্ব বা পাইথাগোরাসের উপপাদ্য মৌলিক নয়, তার শিকড় বৈদিক গণিতে! কৌটিল্য কবেই অর্থশাস্ত্র লিখেছেন, মহাভারতের শান্তিপর্বে আছে অর্থনীতির আসল কথা— এ কালের বইয়ে তা না থাকলে হয়? কর্নাটকে বিজেপি সরকার নিযুক্ত কমিটির সুপারিশ— কেন্দ্রীয় সরকারের জাতীয় শিক্ষানীতিতে রূপায়িত হোক এই সবই, এবং আরও অনেক কিছু: পৌরাণিক ভূগোল, জীববিজ্ঞানে ত্রিদোষ তত্ত্ব, প্রাচীন ভারতের হিসাব পদ্ধতি; সর্বোপরি, মনুস্মৃতি! এ সব পড়ালেই আসল ইতিহাস ভূগোল জানতে পারবে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম— এ কথা বার বার বলে বিজেপি সরকার আসলে যা চাইছে তা স্পষ্ট: স্কুল স্তর থেকেই মগজধোলাই। মোগল শাসক ও ইসলামি শাসনকে অস্বীকার করা, ইতিহাসের বাস্তব মুছে ফেলে হিন্দু রাজা-শাসনকর্তাদের বিজয়ী বলে দাগিয়ে দেওয়া আসলে তাদের হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিরই শিক্ষামুখ। আজ তা প্রকাশ্য ও নির্লজ্জ ভাবে আগ্রাসী, কারণ বিজেপি সরকারের হাতে ‘ক্ষমতা’ আছে, ক্ষমতা আগ্রাসনকে সহজ করে দেয়। এই আগ্রাসনই অ-হিন্দুগন্ধী স্থান-নাম বদলের তাণ্ডবে মাতে, মসজিদ মাত্রেরই নীচে শিবলিঙ্গ খোঁজে, ‘অমুক যুদ্ধে তো হিন্দু রাজা পরাস্ত হয়েছিল’ বলামাত্র তাকে হিন্দুবিদ্বেষী ও দেশদ্রোহী বলে দাগায়। চুপ করিয়ে দেওয়ার নীতির পরবর্তী পদক্ষেপ যা সেটিই চলছে: নতুন ইতিহাস ভূগোল গণিত রচনা— নিজ মতে ও পথে।

গোড়ায় জনমনে সমাজমাধ্যমোচিত হাসাহাসি চলছিল, কিন্তু বিজেপির সাম্প্রতিক নীতি ও প্রস্তাবিত বা গৃহীত পদ্ধতি থেকে পরিষ্কার: এই সরকার শিক্ষার গৈরিকীকরণে বেপরোয়া ও বদ্ধপরিকর। শিক্ষাবিদ বিজ্ঞানী বা সুশীল সমাজের প্রতিবাদে এই দল ও সরকারের কিছু যায় আসে না— দেশের কিছু উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সাম্প্রতিক কালে পৌরাণিক তথা সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক বিষয় নিয়ে সম্মেলন আলোচনা এমনকি গবেষণা বরং তাদের ‘বিজয়’-অভিজ্ঞান— এবং আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তিকেও তারা রেয়াত করে না। পৃথিবীতে দেশে দেশে যুগে যুগে আধিপত্যবাদী ও ফ্যাসিবাদী শাসন-প্রবণতা এ ভাবেই শিক্ষা নামক প্রতিষ্ঠানটিকে দখল করতে চেয়েছে: ধর্ম, বর্ণ বা জাতীয়তাকে ঢাল করে, একটিমাত্র মতাদর্শের রঙে সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থাকে রাঙাতে চেয়ে। এনসিইআরটি-র সাম্প্রতিক বই পুনর্মূল্যায়নে সম্প্রতি শিক্ষাবিদরা খুঁজে পেয়েছেন অন্তর্ঘাত: ভারতে শ্রেণিগত ও ধর্মীয় বৈষম্য বা অস্পৃশ্যতা বিষয়ক বেশ কিছু অনুচ্ছেদ মোছা হয়েছে, বাদ গিয়েছে ‘গণতান্ত্রিক সরকারের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান’ অধ্যায়টিই, সম্রাট অশোক প্রসঙ্গে জওহরলাল নেহরুর প্রাসঙ্গিক মন্তব্য। বই থেকে অপ্রিয় সত্য বা বিরুদ্ধ মত মুছে ফেলার কুকীর্তি নতুন নয়, তার প্রতিরোধী ঐতিহ্যটিও সুপ্রাচীন। অপ্রিয় হলেও যা প্রকৃত ইতিহাস, বিদেশি আবিষ্কার হলেও যা মৌলিক বিজ্ঞান, তাকে কোনও কালেই রোধ করা যায়নি। বরং কালক্রমে মুছে গিয়েছে ক্ষমতার আস্ফালনই। তবু নিয়তিনির্দেশের হাতে ছেড়ে না দিয়ে নিরন্তর সংলাপ ও প্রতিবাদে মগ্ন থাকাই নাগরিকের কর্তব্য। ক্ষমতার বিরুদ্ধে মানুষের প্রতিরোধ আসলে বিস্মরণের বিরুদ্ধে স্মরণের প্রতিরোধ— লিখে গিয়েছে বন্দিত লেখককলম। যা কিছু মুছে ফেলার চেষ্টা চলছে, বারংবার তা উচ্চারণ করে, মনে করিয়ে দিয়ে, অনুশীলন করে তাকে জাগরূক রাখাই ধর্ম। অন্তত এখন।

অন্য বিষয়গুলি:

BJP Karnataka National Education Policy
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy