সুপ্রিম কোর্ট। ফাইল চিত্র।
সাড়ে তিন বছর আগে কেন্দ্রীয় সরকার যে ঐতিহাসিক পরিবর্তন ঘটিয়েছিল, সোমবার সুপ্রিম কোর্টের রায় তাকে অনুমোদন করার ফলে ভারতীয় শাসনতন্ত্রে এক নতুন মাত্রা যুক্ত হল। ‘ঐতিহাসিক’ শব্দটি নিশ্চয়ই সাবধানে ব্যবহার্য, কিন্তু এ ক্ষেত্রে সেটি ব্যবহার না করা অনুচিত। সংবিধানের সূচনাপর্ব থেকে সংরক্ষণের ইতিহাসে এ-যাবৎ জাতিবর্ণকেই (কাস্ট) নির্ণায়ক হিসাবে মান্য করা হয়েছে। তফসিলি জাতি ও জনজাতির পরে সংরক্ষণের আওতায় এসেছে অন্যান্য অনগ্রসর জাতি বা ওবিসি। এই বর্গগুলির সংজ্ঞা এবং কাঠামোয় বিভিন্ন সংশোধন ঘটেছে, সংরক্ষণ নীতির প্রয়োগেও নানা রদবদল করা হয়েছে, তা নিয়ে তর্কও চলেছে অবিরাম। কিন্তু জাতিবর্ণই সংরক্ষণের ভিত্তি হয়ে থেকেছে। ২০১৯ সালে মোদী সরকার সংবিধানে সংশোধন ঘটিয়ে সেই ভিতটিকে প্রসারিত করে— উচ্চবর্ণের ‘অর্থনৈতিক ভাবে দুর্বলতর শ্রেণি’র নাগরিকও সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এবং চাকরিতে ১০ শতাংশ সংরক্ষণের সুযোগ পান। সর্বোচ্চ আদালত জানাল, সেই সংশোধন সংবিধানসম্মত। অর্থাৎ, জাতিবর্ণের পাশাপাশি আর্থিক অবস্থাও সংরক্ষণের মাপকাঠি হিসাবে স্বীকৃত হল। তার ফলে সংরক্ষণ ব্যবস্থার ভিত বা মূলটি প্রসারিত হল। সেই কারণেই এই পরিবর্তনটি মৌলিক। এবং ঐতিহাসিক।
এই রায় সর্বসম্মত নয়। পাঁচ বিচারকের মধ্যে দু’জন ভিন্নমত জানিয়েছেন। কিন্তু সেই মতানৈক্যের প্রধান কারণ, তাঁদের মতে কেবল উচ্চবর্ণের নাগরিকদের ১০ শতাংশ সংরক্ষণের আওতায় রাখলে তফসিলি জাতি ও জনজাতি এবং ওবিসির নাগরিকদের প্রতি বৈষম্য করা হয়, সেটা সংবিধানের মূল কাঠামোর পরিপন্থী। কিন্তু বৃহত্তর প্রশ্নটি ছিল আর্থিক অনগ্রসরতাকে সংরক্ষণের ভিত্তি হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া নিয়ে। সেই প্রশ্নের উত্তরে বিচারপতিদের বক্তব্য: সংবিধানের মূল সুরটির সঙ্গে এই স্বীকৃতির কোনও বিরোধ নেই। এখানেই একটি বড় প্রশ্ন ওঠে। সংবিধানে সংরক্ষণের প্রধান যুক্তি ছিল এই যে, যুগযুগান্তর ধরে যে বর্গগুলি তাদের জাতিপরিচয়ের কারণে সামাজিক বৈষম্যের শিকার হয়ে এসেছে, তাদের সেই ঐতিহাসিক বঞ্চনার আংশিক প্রতিকার করার জন্য কিছু বিশেষ সহায়ক বন্দোবস্ত আবশ্যক, সংরক্ষণ তারই উপায়। আর্থিক দুর্বলতা অর্থাৎ দারিদ্র যত তীব্রই হোক না কেন, তাকে কি সেই গোত্রের পশ্চাৎপদতা বলে গণ্য করা চলে? ওবিসি, দলিত বা আদিবাসী যে অর্থে— বর্গ হিসাবে— বৈষম্যতাড়িত, দরিদ্র নাগরিকের ক্ষেত্রে কি তা প্রযোজ্য?
এই রায় দিতে গিয়ে দুই বিচারপতি প্রশ্ন তুলেছেন: সংরক্ষণ আর কত দিন চলবে? প্রশ্নটি সুপরিচিত। তার উত্তরও সম্ভবত অজানা নয়। জাতিপরিচয় ও সংরক্ষণ ক্রমশ নির্বাচনী রাজনীতির বড় হাতিয়ার হয়ে উঠেছে, প্রায় কোনও রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠীই সেই প্রকরণটিকে হাতছাড়া করতে রাজি নয়, সুতরাং সংবিধানে সাময়িক ব্যবস্থা হিসাবে প্রস্তাবিত হলেও সংরক্ষণ ক্রমাগত সম্প্রসারিত হতে হতে কার্যত চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের রূপ নিয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতেই আর্থিক ভাবে দুর্বলতর উচ্চবর্ণভুক্তদের জন্য সংরক্ষণের নববিধানটি হয়তো এক নতুন জটিলতার সৃষ্টি করবে। এক দিকে এই ব্যবস্থাটির ফলে জাতিভিত্তিক সংরক্ষণের ‘ধার’ কমতে পারে, অন্য দিকে নতুন একটি গোত্রের সংরক্ষণ হয়ে উঠতে পারে রাজনীতির নতুন অস্ত্র। এই জটিল ও দ্বন্দ্বময় প্রক্রিয়ার গতি ঠিক কেমন হবে, তার নিশ্চিত পূর্বাভাস কারও জানা নেই, রাজনীতি নামক সম্ভাবনার শিল্পটির গতি কেবল বিচিত্র নয়, দুর্জ্ঞেয়। কিন্তু ইতিহাসপ্রসূত সামাজিক সমস্যার সুরাহা করতে যে সংরক্ষণের আয়োজন হয়েছিল, আজ তা নিজেই এক বিরাট সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। মহামান্য আদালতের সিদ্ধান্ত শিরোধার্য, কিন্তু সমস্যাটি থেকেই গেল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy