সুপ্রিম কোর্ট। —ফাইল চিত্র।
সমলিঙ্গের দু’জন মানুষের বিবাহ আইনসিদ্ধ নয়— সুপ্রিম কোর্টের এই রায় সঙ্গত কারণেই বহু মানুষকে হতাশ করেছে। আশা ছিল, নারী-পুরুষের বিবাহের পাশাপাশি নারী-নারী এবং পুরুষ-পুরুষ বিবাহও দেশে স্বীকৃত হবে, বিবাহ নামক সম্পর্ক তথা প্রতিষ্ঠানটি তার প্রাচীন ঘেরাটোপ থেকে উদার আধুনিকতার পরিসরে মুক্তি পাবে। একবিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকে দাঁড়িয়ে এই আশা কেবল যুক্তিযুক্ত নয়, অত্যন্ত স্বাভাবিক। বস্তুত, ব্যক্তিস্বাধীনতার আদর্শগত অবস্থান থেকে বিচার করলে নির্দ্বিধায় বলতে হবে— বিবাহের অধিকার নির্ধারণের সময় ব্যক্তির রুচি এবং পছন্দের স্বক্ষমতাই সার্বভৌম হওয়া উচিত, সেই অধিকার কোনও ভাবে খর্বিত হলে তা স্বাধীনতার মৌলিক নীতির পরিপন্থী। মহামান্য সর্বোচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত সমপ্রেমী নাগরিকদের সেই স্বাধীনতা মঞ্জুর করেনি। কেবল তাঁদের নয়, সামাজিক উত্তরণের পক্ষে থাকা যে কোনও নাগরিকেরই হতাশ হওয়ার অধিকার আছে বইকি।
কিন্তু সেই কারণে সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্তটিকে যুক্তিহীন বলা চলে না। বিচারপতিরা এই মামলায় ভারতীয় শাসনতন্ত্রের একটি মৌলিক সূত্র অনুসরণ করেছেন। আইনবিভাগ এবং বিচারবিভাগের এক্তিয়ার বিভাজনের সূত্র। আদালতের কাজ আইন অনুসারে বিচার করা এবং আইনের সাংবিধানিক বৈধতা নির্ধারণ করা; আইন প্রণয়ন এবং সংশোধনের কাজটি আদালতের নয়, আইনসভার, অর্থাৎ সংসদ এবং বিধানসভার। বিবাহ কেবল ব্যক্তিগত সম্পর্ক নয়, একটি আইনি প্রতিষ্ঠানও বটে। দেশের আইনে তার সংজ্ঞা এবং পরিধি নির্দিষ্ট করা আছে। সেই আইন সমলিঙ্গের মানুষের মধ্যে বিবাহকে তার পরিধির বাইরে রেখেছে। পুরনো যুগের প্রচলিত রীতিই বাইরে রাখার কারণ। যুগ বদলেছে, আইন বদলায়নি। অতএব সমপ্রেম ‘বেআইনি’ থেকে গিয়েছে। বিচারপতিদের বক্তব্য: আইন বদলানো তাঁদের কাজ নয়, সে কাজ আইনসভার। এই বক্তব্যের নিহিত যুক্তি অনস্বীকার্য। সাংবিধানিক কাঠামোকে মর্যাদা দেওয়ার ব্যাপারে আদালতের আত্মসংযম বিশেষ মূল্যবান। এ দেশে কিছু কিছু গুরুত্বপূর্ণ মামলায় বিচারবিভাগের অতিসক্রিয়তার প্রশ্ন উঠেছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে সমপ্রেমের বিবাহ সম্পর্কে পাঁচ বিচারপতির সংযত সিদ্ধান্তটি তাৎপর্যপূর্ণ।
সংসদকে আইন সংশোধনে উদ্যোগী হওয়ার ‘ইতিবাচক নির্দেশ’ দিতেও তাঁরা কেন রাজি হননি, সেই প্রশ্ন অবশ্য থেকেই যায়। অন্য কোনও কোনও ক্ষেত্রে, বিশেষত সমকামী যৌন আচরণকে অপরাধের তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার সময় সর্বোচ্চ আদালত যখন সংসদকে আইন সংশোধনের প্রণোদনা দিয়েছেন, তখন এ ক্ষেত্রেই বা নয় কেন? প্রশ্নটি কেবল তাত্ত্বিক নয়, বাস্তব পরিপ্রেক্ষিতেও প্রাসঙ্গিক। আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধন করে সমলিঙ্গের বিবাহকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য সংসদ তৎপর হবে, এমন সম্ভাবনা সুদূরপরাহত। শাসক বিজেপি তথা সঙ্ঘ পরিবার এ বিষয়ে কেবল প্রাচীনপন্থী নয়, ভয়ানক রকমের অন্ধকারপন্থী। সঙ্কীর্ণতার অন্ধকার। মানবিক সম্পর্ক, দাম্পত্য, যৌনতা, বিবাহ ইত্যাদি প্রশ্নে তাদের চিন্তাভাবনা কোন মান্ধাতা আমলের পিতৃতন্ত্রের ছাঁচে ঢালা হয়ে আছে, সেটা তাদের বিবিধ নেতা-মন্ত্রীর বয়ানেই বারংবার প্রকট হয়ে ওঠে, এই মামলার প্রসঙ্গেও উঠেছে। বিরোধীদের মধ্যেও সমপ্রেম বিবাহ সম্পর্কে যথার্থ উদার চিন্তাভাবনা খুব সুলভ বলা চলে না। সুতরাং সংসদকে যদি আইন সংশোধনে প্রবৃত্ত করতে হয়, তা হলে প্রবল সামাজিক চাপ সৃষ্টি করাই একমাত্র উপায়। এ কথা ঠিকই যে, সমপ্রেম সম্পর্কে সমাজের সুচিন্তা ক্রমশ জাগ্রত হচ্ছে, প্রসারিতও হচ্ছে। সমপ্রেম বিবাহের আইনি স্বীকৃতির দাবিতে যে মামলাটি হল, সেটিই এই অগ্রগতির অন্যতম প্রমাণ। বিচারপতিরা যে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় সমপ্রেমের স্বাধীনতাকে মর্যাদা দেওয়ার কথা বলেছেন, তার সামাজিক গুরুত্বও কম নয়। কিন্তু এখনও অনেক পথ হাঁটা বাকি। অন্ধকার থেকে নিষ্ক্রমণের পথ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy