—প্রতীকী ছবি।
উত্তরে কাশ্মীরের ইন্দিরা কল থেকে দক্ষিণে কন্যাকুমারী, পূর্বে অরুণাচল প্রদেশের কিবিথু থেকে পশ্চিমে গুজরাতের গুহর মোতি— পাহাড় থেকে সমুদ্র, অতি বৃষ্টিপ্রবণ অঞ্চল থেকে ধু ধু মরুভূমি, গহন বনাঞ্চল থেকে অত্যাধুনিক শহর, সব মিলিয়ে পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রটি কাদের? ভারত নামক দেশটিতে কাদের অধিকার? মাত্র এক দশক আগেও এমন প্রশ্ন করার প্রয়োজনই পড়ত না— শত বিরোধ, সহস্র মনোমালিন্য সত্ত্বেও ভারত জানত, বৈচিত্রের মধ্যে একতাই এই দেশের প্রধানতম পরিচয়। শেষ দশ বছরে বারে বারেই সংশয় হয়েছে যে, সত্যিই কি ভারতবাসী তাদের প্রকৃত পরিচয় বিস্মৃত হয়েছে? লোকসভা নির্বাচনের অব্যবহিত আগে সিএসডিএস-লোকমত’এর একটি সমীক্ষা আশ্বস্ত করল— আশা আছে, আশা আছে। এখনও দেশের প্রায় আশি শতাংশ মানুষ মনে করেন যে, কোনও একটি নির্দিষ্ট ধর্মের নয়, ভারতের উপরে সব ধর্মাবলম্বী মানুষের সমান অধিকার। শুধু সংখ্যালঘু মানুষরাই নন, সমীক্ষায় অংশগ্রহণকারী প্রতি দশ জন হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষের মধ্যে আট জন বিশ্বাস করেন, শুধু হিন্দুদের নয়, এ দেশ সব ধর্মাবলম্বীর— ‘এ দেশ তোমার-আমার’। মাত্র ১১ শতাংশ মানুষ রায় দিয়েছেন যে, ভারত শুধুই হিন্দুদের। ধর্মীয় বহুত্বের প্রতি এই বিপুল জনমতের ছাপ নির্বাচনের ফলে কতখানি পড়বে, সে প্রশ্নটি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু গুরুত্ব শুধু সেটুকুতেই সীমাবদ্ধ নয়— ভারতকে উদারবাদী বহুত্বের পথ থেকে বিচ্যুত করে ক্রমশ তাকে হিন্দুরাষ্ট্র করে তোলার দীর্ঘ এক দশকের রাষ্ট্রীয় প্রচেষ্টা সত্ত্বেও এত মানুষ এখনও ভারত নামক ধারণাটির প্রতি বিশ্বস্ত, এই কথাটি বারংবার বলার মতো, নিজেদের মনে করিয়ে দেওয়ার মতো।
সমীক্ষার এই ফলাফলটি রাজনীতির ক্ষেত্রে অন্তত দু’টি মাত্রায় তাৎপর্যপূর্ণ। প্রথমত, হিন্দুরাষ্ট্রের খোয়াব দেখিয়েই যে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে সন্তুষ্ট রাখা যাবে না, গৈরিক জাতীয়তাবাদীরা সে কথাটি বুঝে নিতে পারেন। লক্ষণীয় যে, এই সমীক্ষাতেই দেখা গিয়েছে, জনসংখ্যার একটি বড় অংশ রামমন্দির প্রতিষ্ঠাকে এই সরকারের অন্যতম সেরা কৃতিত্ব বলে বিবেচনা করেন। একই সঙ্গে বহুত্ববাদী ভারত ও রামমন্দিরের পক্ষে রায় দেওয়াকে আপাতদৃষ্টিতে পরস্পরবিরোধী বলে মনে হতে পারে— কিন্তু, তার সম্ভাব্য ব্যাখ্যাটি হল, মন্দিরপন্থী জনতারও একটি বড় অংশ মন্দির এবং দেশকে এক করে দেখতে রাজি নন। সমীক্ষা বলছে, মূলত উচ্চবর্ণের হিন্দু ধনী তুলনায় বয়স্ক পুরুষরাই প্রবল হিন্দুত্বের সমর্থক। অন্য দিকে, উচ্চশিক্ষিত, তরুণ এবং দরিদ্রতর মানুষরা অনেক বেশি বহুত্ববাদে বিশ্বাসী। অবাক হওয়ার অবকাশ নেই, কারণ গরিব মানুষ জানেন যে, ধর্মের বদলে পেটে ভাত থাকা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এবং, জনসংখ্যার একটি অংশকে বাদ রাখলে বাকি অংশের উন্নয়নের গতি বাড়ে না, বরং কমে। শিক্ষা যে বোধ তৈরি করে কেতাবি ভঙ্গিতে, জীবন সে কথাটিই শিখিয়ে দেয় হাতেকলমে।
দ্বিতীয় তাৎপর্যটি বিজেপি-বিরোধী রাজনীতির জন্য। অধিকাংশ দলের ভঙ্গি দেখলে সংশয় হয় যে, তারা হয় চিরস্থায়ী পরাজয় স্বীকার করে নিয়েছে, বা হিন্দুত্বেরই ভিন্নতর পথে হাঁটতে চায়। অথবা, অন্য কোনও ধর্মের ধ্বজা উড়িয়ে তৈরি করতে চায় অন্য কোনও ধর্মীয় রাজনৈতিক ভাষ্য। সেই দলগুলি মানুষের এই রায়ের কথা মনে রাখতে পারে। ধর্মীয় উগ্রতা, অসহিষ্ণুতা যে এখনও এই ভারতের অধিকাংশ মানুষের কাম্য নয়, এ কথা মনে রাখলে হয়তো বোঝা সহজ হবে যে, বিভেদকামী প্রবলপ্রতাপ রাজনৈতিক দলটিকে হারানোর জন্য ধর্মীয় ভাষ্য নয়, প্রয়োজন উন্নয়নের বিকল্প রূপরেখা। ইতিহাস সাক্ষ্য দেবে, উন্নয়ন যত অধরা হয়, ততই বাড়তে থাকে সংখ্যাগরিষ্ঠের পরিচিতি-ভিত্তিক আধিপত্যের দাবি। ভারত নামক ধারণাটিকে অক্ষত রাখতে হলে বিরোধী রাজনীতিকে দেশের নাড়ির স্পন্দন বুঝতে হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy