প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ফাইল চিত্র।
মন কি বাত’ অনুষ্ঠানটির শততম সম্প্রচারের পর থেকে একটি পরিচিত প্রশ্ন ফের অতি জোরালো ভাবে উঠতে আরম্ভ করেছে— এত কথা বলেও প্রধানমন্ত্রী কিছুই বললেন না কেন? যখন যে বিষয়গুলি নিয়ে দেশ উত্তাল, যে সব প্রশ্নের সদুত্তর পাওয়ার হক দেশের প্রতিটি নাগরিকের রয়েছে, সে বিষয়গুলি কেন কখনও প্রধানমন্ত্রীর আলোচ্যসূচির অন্তর্গত হয় না? কেন জাতির উদ্দেশে তাঁর সেই ভাষণগুলি শুধুমাত্র অকিঞ্চিৎকরতার উদ্যাপন হয়ে থাকে? এই খেদসঞ্জাত প্রশ্নগুলিই আসলে অবান্তর। ‘মন কি বাত’ শীর্ষক অনুষ্ঠানটি, এবং তার সঙ্গে বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়া, প্রধানমন্ত্রীর জনজ্ঞাপন ব্যবস্থার অতি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। এগুলির সঙ্গে আছে বিভিন্ন জনসভায় ভাষণ। প্রধানমন্ত্রী কথা বলেন মূলত এই পরিসরগুলিতে— সংসদে মুখ খোলেন অতি সামান্যই, সাংবাদিক সম্মেলন করেন না, পছন্দের বিজ্ঞাপননির্মাতা বা চলচ্চিত্রাভিনেতারা উল্টো দিকে না থাকলে পারতপক্ষে টেলিভিশনে সাক্ষাৎকারও দেন না। তিনি যা করেন, এবং যা করেন না, দুইয়ের মধ্যে সূত্র একটিই— তাঁর জনজ্ঞাপন সর্বদাই একমুখী; তাঁর যা বলার, তিনি শুধু সেটুকুই বলেন, অন্য কোনও প্রশ্নের উত্তর দেন না। এই প্রশ্নগুলি সরাসরি তাঁর কাছে পৌঁছতে পারে, এমন কোনও পরিসর তিনি রাখেননি। পুলওয়ামা-কাণ্ড বিষয়ে সত্যপাল মালিক যে অভিযোগগুলি করেছেন, অথবা আদানি-কাণ্ডে বিরোধীরা তাঁর দিকে অভিযোগের যে আঙুল তুলেছেন, প্রধানমন্ত্রী সেই প্রশ্নগুলির উত্তর ‘মন কি বাত’-এর বেতার সম্প্রচারে দেবেন, এমন আশা করলে বলতে হয়, গত ন’বছরে বিরোধীরা তাঁকে বিন্দুমাত্র বুঝতে পারেননি।
গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন এক সাক্ষাৎকার থেকেই প্রধানমন্ত্রী সম্ভবত শিখে নিয়েছিলেন যে, প্রশ্নের অবকাশ না রাখলে উত্তর দেওয়ারও আর দরকার থাকে না। ফলে, তাঁর প্রয়োজন ছিল এমন মাধ্যমের, যেখানে প্রশ্নোত্তরের বালাই নেই, যেখানে তিনিই একতরফা নিজের কথা বলে যেতে পারবেন। একই সঙ্গে সোশ্যাল মিডিয়ার মতো নবযুগের গণমাধ্যম এবং বেতারের মতো সনাতনী মাধ্যমকে নিজের সেই প্রশ্নের সম্ভাবনাহীন জনজ্ঞাপনের কাজে ব্যবহার করতে পারার মধ্যে যে রাজনৈতিক কল্পনাশক্তি রয়েছে, তাকে অস্বীকার করার উপায়মাত্র নেই। এ-যাবৎ কাল কোনও প্রধানমন্ত্রী যে কাজটি করতে সক্ষম হননি, নরেন্দ্র মোদী তা অবলীলায় করে ফেলেছেন— তাঁর স্বনির্বাচিত নীরবতাকে, অস্বস্তিকর প্রশ্নকে সম্পূর্ণ এড়িয়ে যাওয়াকে তিনি জনগণের চোখে বৈধ প্রতিপন্ন করতে পেরেছেন। সেই বৈধতা এমনই যে, এখন প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে কেউ কোনও প্রশ্ন করলে তাকে সরাসরি রাষ্ট্রদ্রোহিতা বলে চিহ্নিত করে দিতেও বাধা নেই। আজকের ভারতে সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক তাতে আর বিচলিত হবেন না বলেই সংশয় হয়।
উত্তরে মৌন থাকার এই বিলাসিতা কোনও প্রধানমন্ত্রীর প্রাপ্য নয়। যে প্রশ্নে দেশ উতরোল হয়, সেই প্রশ্নের সদুত্তর দেওয়ার দায় প্রধানমন্ত্রীর উপর বিলক্ষণ বর্তায়। কিন্তু বিরোধীরাও দায়হীন নন। জনতার দরবারে প্রধানমন্ত্রীকে জবাবদিহিতে বাধ্য করার দায়িত্বটি বিরোধীপক্ষের উপরে ছিল। কেন প্রধানমন্ত্রী তাঁর শততম ‘মন কি বাত’-এও কোনও গুরুতর প্রশ্নের উত্তর দিলেন না, এই দায়সারা সওয়াল তুলে সেই কর্তব্য সমাধা হয় না। জনগণের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংযোগের ভঙ্গিমাটি যে ছলনামাত্র, সেই পথে প্রধানমন্ত্রী যে আসল প্রশ্নগুলি ক্রমাগত এড়িয়ে চলেছেন, এই কথাটি জনতার দরবারে বিশ্বাসযোগ্য ভাবে পেশ করার দায়িত্ব ছিল বিরোধীদের। গণমাধ্যম যে আসলে গণতন্ত্রে সাধারণ মানুষের সবচেয়ে বড় শুভাকাঙ্ক্ষী; এবং যে গণমাধ্যম যত বেশি প্রশ্নশীল, তার ভূমিকা যে ততই আদরণীয়, এই কথাটিও বলার প্রয়োজন ছিল। বিরোধীরা নিজেদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ, তাই প্রধানমন্ত্রী আক্ষরিক অর্থেই একশো বার শুধু নিজের কথাটুকু বলেও পার পেয়ে যান।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy