—প্রতীকী ছবি।
গল্পগুলো অশ্রুতপূর্ব নয়, বরং নিয়মিত শোনা যায়। কিন্তু এই নৈরাশ্যের অন্ধকারে সেই পরিচিত কাহিনিরা যেটুকু আশা জাগাতে পারে, সেটুকুই সমাজের বড় সম্বল। কল্পকাহিনি নয়, কঠোর বাস্তব। বরাবরের মতোই এ-বছরেও মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিকের মতো ‘বড়’ পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এক দিকে ‘মেধা তালিকা’র বৃন্দগানে আকাশবাতাস মুখর হয়ে উঠেছে, অন্য দিকে জানা গিয়েছে দারিদ্রের সঙ্গে দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করে সফল হওয়া পরীক্ষার্থীদের কথা। সমাজে অসাম্য বেড়ে চলেছে দুর্বার গতিতে, শিক্ষার ভুবনেও তার প্রভাব অতিমাত্রায় প্রবল— ছেলেমেয়েকে ভাল করে লেখাপড়া শেখানো ক্রমশই বহু থেকে বহুতর নাগরিকের সাধ্যাতীত হয়ে পড়ছে। যে শিক্ষাকে এক সময় ‘সাম্য প্রসারের উপায়’ মনে করা হত, আজ তা বহুলাংশে অসাম্য বাড়িয়ে তোলার প্রকরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই পরিস্থিতিতে কঠিন জীবনের মোকাবিলা করে যে কিশোরকিশোরীরা সাফল্য অর্জন করেছে, তাদের অকুণ্ঠ অভিবাদন। অভিবাদন তাদের অভিভাবক এবং শিক্ষকদের, তাঁরা এই অসাধ্যসাধনে তাদের সহায় এবং সহযাত্রী।
তার পর? অভিবাদন জানিয়েই কি বৃহত্তর সমাজের দায়িত্ব মিটতে পারে? এ প্রশ্নের বিচার করা দরকার দু’টি স্তরে। প্রথমত, যে ছাত্রছাত্রীরা ভাল ফল নিয়ে স্কুলের পাঠ শেষ করছে, তাদের উচ্চতর শিক্ষার পথে অনেক ক্ষেত্রেই আর্থিক সঙ্গতির অভাব আরও অনেক বড় বাধার সৃষ্টি করে, কারণ উচ্চশিক্ষা আরও বহুগুণ ব্যয়সাধ্য, তার সুযোগ অনেক বেশি সীমিত। সুখের কথা, এই ধরনের সাফল্যের কাহিনিগুলি প্রচারিত হওয়ার ফলে বহু ক্ষেত্রেই সহৃদয় নাগরিকদের ব্যক্তিগত বা প্রাতিষ্ঠানিক সাহায্য মেলে, অনেকেই তা কাজে লাগিয়ে সাফল্যের পরবর্তী সোপান রচনা করতে পারে। এমন সামাজিক সহায়তার ঐতিহ্য অতীতেও ছিল, সাধারণ ঘর থেকে উঠে আসা অনেক কৃতবিদ্য মানুষের জীবনকাহিনিতেই তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত আছে। সংখ্যার বিচারে তেমন দৃষ্টান্ত এ-কালে অবশ্যই অনেক বেশি, যদিও সম্পন্ন বা সচ্ছল নাগরিকের সামর্থ্যের অনুপাতে বেশি কি না তা নিয়ে বড় রকমের সংশয় আছে।
কিন্তু প্রশ্নের দ্বিতীয় স্তরটি আরও গুরুতর। বস্তুত, সেটাই শিক্ষার সামাজিক ভূমিকা সম্পর্কে গভীরতম প্রশ্ন। অন্তত প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক স্তরের স্কুলশিক্ষায় দরিদ্র ছাত্রছাত্রীদের সাফল্য কেন তাদের ‘অস্বাভাবিক’ এবং ‘ব্যতিক্রমী’ সংগ্রামের উপর নির্ভর করবে? সমাজ এবং রাষ্ট্র কেন স্বাভাবিক প্রক্রিয়াতেই, ‘নিয়ম’ হিসাবেই তাদের সর্বতোভাবে সাহায্য করবে না? দারিদ্র দূর করার বৃহত্তর বিষয়টির সঙ্গে এই প্রশ্নের সংযোগ আছে, কিন্তু কবে দারিদ্র দূর হবে সেই প্রতীক্ষায় বসে না থেকে তার সদুত্তর খোঁজাও অত্যন্ত জরুরি। সরকার যাঁরা চালান তাঁরা নিজে থেকে এ বিষয়ে যথেষ্ট উদ্যোগী হবেন, এমন ভরসা নেই। সমাজের কাজ তাঁদের বাধ্য করা। কিন্তু মুশকিল হল, আমাদের সমাজ ব্যতিক্রমী এবং অস্বাভাবিক কৃতিত্বের গুণগান করতে, কৃতীদের সংবর্ধনা জ্ঞাপন করতে, এবং অনেক ক্ষেত্রে তাদের কিছুটা সাহায্য করতেও যতটা উৎসাহী, আর্থিক ভাবে দুর্বল ছাত্রছাত্রীদের কাছে সুশিক্ষার যথার্থ সুযোগ পৌঁছে দেওয়ার একটি সামগ্রিক আয়োজন গড়ে তোলার ব্যাপারে তার সিকি ভাগ আগ্রহও দেখা যায় না। অনুমান করা যেতেই পারে, এই অনাগ্রহের পিছনে এমন একটি ধারণা কাজ করে যে, কিছু ছেলেমেয়ে যখন কঠিন পরিস্থিতির মধ্যেও সফল হতে পারে, তখন অন্যদেরও তেমনটাই পারা উচিত, না পারলে সেটা তাদেরই অক্ষমতা বা দোষ। দারিদ্রের জন্য দরিদ্রকে দায়ী করার প্রবণতা এই সমাজের ঐতিহ্যে মজ্জাগত, এ ক্ষেত্রেও হয়তো তার প্রতিফলন ঘটে। অতএব, ব্যতিক্রমী সাফল্যকে অকুণ্ঠ অভিবাদন জানানোর সঙ্গে সঙ্গে এই দাবিটি বিশেষ ভাবে তোলা দরকার যে— ব্যতিক্রমের যেন প্রয়োজন না হয়, সেটা নিশ্চিত করাই কর্তব্য। সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কর্তব্য।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy