বাংলা নববর্ষ। ফাইল চিত্র।
নববর্ষের অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথের যে গানগুলি সর্বাধিক গীত হয়ে থাকে, ‘এসো হে বৈশাখ’ তাদের প্রথম সারিতে, হয়তো সর্বাগ্রে। ১৩৩৩ বঙ্গাব্দের ফাল্গুন মাসে লেখা হয়েছিল এ-গানের বাণী। প্রকৃতি এবং জীবনের দ্বৈত মাত্রায় সংবাহিত নতুন বছরের এই আবাহন-গীতি এক অনন্য সৃষ্টিপ্রতিভার নির্ভুল অভিজ্ঞান হিসাবেই আজও অমলিন। তার একটি পঙ্ক্তি বলে: বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক। এই কথাটিতে কবির প্রত্যাশা বাঙ্ময় হয়ে ওঠে, আবার শোনা যায় তাঁর আর্তির সুরও। কেবল শুকনো শাখা আর ঝরা পাতার স্তূপ উড়িয়ে দেওয়ার আহ্বান নয়, ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা থেকে জগৎ ও জীবনের মুক্তির দাবিও সেখানে নিহিত। চতুর্দিকে পরিব্যাপ্ত যে সামাজিক জরা ও ব্যাধির অভিঘাত রবীন্দ্রনাথকে নিরন্তর বেদনার্ত ও উদ্বিগ্ন করে, পুরনো বছরের সঙ্গে সঙ্গে তা বিদায় নেবে, এমন কোনও ইন্দ্রজালে নিশ্চয়ই তাঁর আস্থা ছিল না, তিনি বিশ্বাস রেখেছিলেন মানুষের প্রতি। মানুষই পারে সমাজের জীর্ণদেহে নতুন প্রাণের সঞ্চার ঘটাতে, যাকে অভিবাদন জানিয়ে গত শতাব্দীর চল্লিশের দশকে জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র তাঁর সুদীর্ঘ কবিতা ‘মধুবংশীর গলি’-র অন্তিম পর্বে উচ্চারণ করবেন: বৃদ্ধযুগের গলিত শবের পাশে, প্রাণকল্লোলে ঐ নবযুগ আসে। নববর্ষ সেই প্রাণকল্লোলের কাল। বিগত বৎসরের আবর্জনা দূর করবার কাল।
প্রায় এক শতাব্দী পরে আজ পশ্চিমবঙ্গের সমাজ যেখানে এসে পৌঁছেছে, রবীন্দ্রনাথের পক্ষে তা কল্পনা করা সম্ভব ছিল না। নববর্ষের প্রত্যুষে দাঁড়িয়ে এই রাজ্যের নাগরিক যদি ফেলে আসা বছরটির দিকে ফিরে তাকান, যে দৃশ্য তিনি দেখবেন সেখানে অন্য সব কিছুকে ছাপিয়ে জেগে থাকবে এক আদিগন্ত আবর্জনার স্তূপ। দিনের পর দিন ক্ষমতার কদর্য আস্ফালন, সর্বব্যাপী দুর্নীতি, অন্তঃসারশূন্য কলহ আর লজ্জাকর অপদার্থতার অগণন কাহিনির উন্মোচন করতে করতেই একটা গোটা বছর অতিক্রান্ত। এবং, ক্যালেন্ডার পাল্টে গেলেই বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাবে, এমন প্রত্যাশার বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই, বরং সমস্ত দিক থেকে নাগরিকের কছে যে সুস্পষ্ট সঙ্কেতগুলি ভেসে আসছে তা এই যে, বৃদ্ধযুগের গলিত শবটি ভবিষ্যতে আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে, ক্ষমতা এবং অর্থের উদগ্র আকর্ষণ তীব্রতর ও প্রবলতর হয়ে উঠতে পারে। নবাগত ১৪৩০ সালকে এই অপ্রিয় সত্যটি সাফ সাফ জানিয়ে দেওয়াই বিধেয় যে, তার চলার পথে অন্তত এই মুহূর্তে কোনও আলোকরেখা নেই।
কিন্তু তবুও, বঙ্গসমাজের পা থেকে মাথা পর্যন্ত ঘনিয়ে আসা সভ্যতার গভীর সঙ্কটের মধ্যে দাঁড়িয়েও রবীন্দ্রনাথ মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারাবেন না, তিনি বলবেন অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলোর সন্ধান করাই সমাজের দায়িত্ব। সেই দায়িত্ব আজ পশ্চিমবঙ্গের নাগরিকদের শিয়রে সমুপস্থিত। কোনও অ-লৌকিক শক্তি তাঁদের তমসা থেকে আলোকে উত্তরণের পথ দেখাতে অবতীর্ণ হবে না। সরকারি ক্ষমতার বিবিধ দরবারে যাঁরা অধিষ্ঠিত, তাঁরা সম্ভবত অন্ধকার এবং আলোর তফাত করতেই অপারগ। রাজনীতির ময়দানে রকমারি খেলোয়াড়রা যে যার নিজস্ব শবসাধনায় আমোদিত। দায়িত্বশীল নাগরিককেই এখন আপন বুকের পাঁজর জ্বালিয়ে নিয়ে আলো জ্বালাতে হবে। কিন্তু একলা নয়— এ কাজ কারও একার হতে পারে না। কোনও মহান সমাজ-নায়ক নেতৃত্ব দেবেন আর অন্যরা তাঁকে অনুসরণ করবেন, এমন ভাবনাও বাতুলতামাত্র। প্রত্যেক সচেতন এবং সুচেতন বঙ্গবাসীকে দৃঢ় ও সৎ প্রত্যয়ে বলতে হবে: আর নহে, আর নয়। ক্ষমতাবানের অন্যায়ের বিরুদ্ধে যে যার নিজস্ব জীবনে ও কাজে এই প্রতিস্পর্ধী অবস্থান নিতে পারলে এক অ-পূর্ব সামাজিক সংহতি তৈরি হতে পারে। বাইরে থেকে আরোপিত সমষ্টির সংহতি নয়, অন্তর থেকে জাগ্রত আত্মশক্তির সংহতি। এই পথে আলো জ্বেলে, এ পথেই আলো জ্বেলে বঙ্গসমাজের ক্রমমুক্তি সম্ভব। নান্যঃ পন্থা...
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy