শেখ হাসিনা। —ফাইল চিত্র।
আরও এক বার, এ নিয়ে পঞ্চম বার, শেখ হাসিনা ওয়াজ়েদ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। তাঁর এই নতুন শাসনপর্বের সূচনায় ভারত থেকে শুরু করে বহু দেশ থেকে ভেসে আসছে উষ্ণ অভিনন্দন। এই উষ্ণতা প্রত্যাশিত। নির্বাচন ঘিরে নানা অনিশ্চয়তা ও উদ্বেগের অবসানে এখন সে দেশে আবার শান্তি ফেরার কথা, প্রতিবেশী সম্পর্কে ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কে স্থিতি ও গতি ফেরার কথা। বাস্তবিক, এক বিপুল চ্যালেঞ্জের সামনে বাংলাদেশকে প্রায় তিন দশক ধরে যে ভাবে নেতৃত্ব দিয়ে চলেছেন শেখ হাসিনা, তা এক বিরাট ঐতিহাসিক কৃতিত্ব। কেবল বাংলাদেশ কেন, সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিই এই কারণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে কৃতজ্ঞ বোধ করতে পারে। ভারতের স্বস্তির কথা আলাদা করে বলা জরুরি। ৪১০০ কিলোমিটার পারস্পরিক সীমান্ত সম্বলিত প্রতিবেশী দেশে কোনও অমিত্রসুলভ শাসক এলে, কিংবা কট্টর ইসলামি রাজনীতির প্রাধান্য কোনও ভাবে প্রতিষ্ঠিত হলে, কেবল কেন্দ্রীয় সরকার কেন, পূর্ব ভারতের আঞ্চলিক সরকারগুলিরও স্বস্তিবোধে বিষম বিঘ্ন ঘটতে পারত। পশ্চিমবঙ্গ, অসম, মেঘালয়, ত্রিপুরা ও মিজ়োরাম— প্রতিটি রাজ্যেই বাংলাদেশ সীমান্ত প্রত্যহ একটি সংবেদনশীল বিষয়। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ঢাকার সঙ্গে দিল্লির নিরাপত্তা-সংক্রান্ত বিষয়গুলি নিয়ে উত্তম বোঝাপড়া আগামী পাঁচ বছর অক্ষুণ্ণ থাকবে, তাঁর ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তনে এই আশাই প্রজ্বলিত রইল— এ এক সুসংবাদ।
তবে সবটুকুই সুসংবাদ নয়। এ বার ভোটে ৩০০ আসনের মধ্যে ২২৩টি পেয়েছে আওয়ামী লীগ। বিরোধী দল ভোটে যোগ না দেওয়ার ফলে বিপরীতে যাঁরা জিতেছেন, তাঁদের সকলেই নির্দল প্রার্থী। এবং এই নির্দলদের প্রায় সকলেই আওয়ামী লীগ থেকে কখনও না কখনও বিতাড়িত হওয়া প্রার্থী। অর্থাৎ, শাসক দল ও সেই দলের বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠী— ভোটে যোগ দিয়েছিলেন এঁরাই। স্বভাবতই, ভোটের সুষ্ঠু সমাপন সত্ত্বেও ঠিক এই জায়াগাটাতেই বিঁধে থাকছে তীক্ষ্ণ ও অমোঘ প্রশ্নবাণসমূহ— যেগুলি এড়িয়ে যাওয়া পঞ্চম বারের বিজয়িনীর পক্ষেও অসম্ভব। বিরোধীহীন পরিস্থিতিতে একই দলের ছত্রছায়ায় সংঘটিত ভোটের এই সাফল্য নেত্রী বিষয়ে যা-ই বলুক, গণতন্ত্র নিয়ে কী বলে— দেশের তিপ্পান্ন বছরে এসে তাতে আজ গুরুতর প্রশ্নচিহ্ন। দক্ষিণ এশিয়ায় গণতন্ত্রের নামে একদলতন্ত্র, কিংবা সামরিকতন্ত্র, চলার নিদর্শন নিতান্ত পরিচিত। বাংলাদেশের গণতন্ত্রের স্বাস্থ্য বিষয়ক উদ্বেগকে তাই লঘু করে দেখা অসম্ভব। আমেরিকা ও ইউরোপের নানা দেশের সরকারি মহলে এখন আর কানাঘুষো নয়, রীতিমতো প্রকাশ্য জল্পনা চলছে এ নিয়ে। বাংলাদেশের বিরোধী দল বিএনপি ঠিক এটাই চাইছে, তাই একের পর এক নির্বাচনে যোগ না দিয়ে নির্বাচনের বৈধতা বিষয়ে বিশ্বমনে প্রশ্ন তৈরি করছে। সব মিলিয়ে, নির্বাচন-উত্তর পরিস্থিতিতে ব্যক্তিগত ও দলগত ভাবে সাফল্যের মধ্যে দাঁড়িয়েও শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগকে উদ্বেগহীন মনে হয় না।
ঘটনা হল, ভূরাজনৈতিক ভাবে বাংলাদেশের গুরুত্ব এখন পশ্চিমের কাছেও অনেক বেশি, ভারতের কাছেও। এক দিকে ইসলামি সন্ত্রাসের মোকাবিলা, পশ্চিম এশিয়ার অস্থিরতা, এবং অন্য দিকে, চিনের মহাপ্রতাপ প্রতিষ্ঠা ও বিস্তার প্রকল্পের বৃহত্তর নকশায় বাংলাদেশ আজ আর কোনও অনুল্লেখযোগ্য দেশ নয়। এখন মানব-উন্নয়নের বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশের অগ্রগতি দ্রুত, ভারতের তুলনাতেও দ্রুততর। তদুপরি ভারতের স্থিতি রক্ষায় তার বিশেষ ভূমিকা পশ্চিম বিশ্বকে সর্বদা মাথায় রাখতে হয়। ফলে গণতন্ত্র-নীতি থেকে বিচ্যুতির ক্ষেত্রেও শেষ অবধি আন্তর্জাতিক সঙ্কট এখনই ঘনাবে না, শেখ হাসিনা জানেন। তবে অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে সঙ্কট ঘনাতেই পারে। বড় সঙ্কটও। গণতন্ত্রকে তার নিজের পথে চলতে না দিলে শেষ অবধি গণতন্ত্রই সবচেয়ে বিপন্ন হয়, ইতিহাস সাক্ষী।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy