হলুদ ধোঁয়ায় ভরে গিয়েছে সংসদ ভবন। —ফাইল চিত্র।
ইতিহাস ফিরে ফিরে আসে, ফিরে ফিরে তার থেকে শিক্ষা নিতে হয়। কিন্তু ফিরে ফিরেই যদি বোঝা যায় যে ‘শিক্ষা’ আসলে নেওয়া হয়নি, এবং শিক্ষা নেওয়া হয়নি বলেই ইতিহাস ফিরে আসছে তা হলে বিষয়টি খুবই গুরুতর হয়ে দাঁড়ায়। সংসদের মধ্যে যে কাণ্ড অতি সম্প্রতি ঘটে গেল, ওই দিনটিতেই, যে দিন সংসদের উপর এক ঐতিহাসিক আক্রমণের চেষ্টা হয়েছিল বাইশ বছর আগে— তা দেখেশুনে এই কথাটিই বলতে হয়। নিরাপত্তার এমন ফস্কা গেরো, সংসদের মতো ভবনের ক্ষেত্রে, এক কথায়, অমার্জনীয়। অনেক সময় নিরাপত্তার সমস্ত রকম সুব্যবস্থা সত্ত্বেও আক্রমণ আটকানো যায় না, আমেরিকার ক্যাপিটল হিল-এর অভাবনীয় অভিজ্ঞতা এই প্রসঙ্গে মনে করা যেতে পারে। কিন্তু দিল্লিতে ১৩ ডিসেম্বর যা ঘটল, তার মধ্যে নিরাপত্তা ব্যবস্থা গাফিলতি অতিশয় স্পষ্ট। যে যন্ত্রপাতি সহকারে অপরাধীরা প্রবেশ করেছিলেন, সুরক্ষাক্ষেত্রে গাফিলতি ছাড়া তা তৈরি হতে পারত না। বিষয়টিকে লঘু করে দেখা অসম্ভব। এবং যে নতুন সংসদ ভবন নিয়ে বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের শ্লাঘা অন্তহীন, সেখানে এমন কাণ্ড ঘটার দায় ও দায়িত্ব গ্রহণ করে তাঁদের লজ্জায় অধোবদন হওয়া উচিত। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছ থেকে বিরোধীরা যে প্রকাশ্য দায়গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন, তা সম্পূর্ণ সঙ্গত। আশা থাকল, কেবল ‘পান্ডা’কে ধরে, এবং জনা-চারেক অপকর্মকারীর বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার ধারায় অভিযোগ এনেই তিনি ও তাঁর দফতর ক্ষান্ত হবেন না। আসল কাজটি করবেন— কোনও প্রতিবাদই যাতে সংসদের মধ্যে এমন বিপজ্জনক পরিস্থিতি তৈরি করতে না পারে, তার দিকে নজর দেবেন।
দু’টি কথা বলার থেকে যায়। প্রথমত, শেষ অবধি যে-হেতু ক্ষতি তত হয়নি, অপরাধীদের অপরাধকে হালকা ভাবে দেখার একটি অবকাশ থেকে যাচ্ছে। কিন্তু এ ধরনের ভাবনার গলদ হল, ক্ষতি কম না বেশি, সেটা যে-হেতু ঘটনার পরই বোঝা যায়, এই ভাবে বিপদ আটকানো সম্ভব নয়। বাস্তবিক, ঘটনার ফল আরও অনেক ভয়ানক হতে পারত, যে গ্যাস ও ধোঁয়া নির্গত হল, তা আরও অনেক বিষাক্ত হতে পারত। সুতরাং ‘তেমন কিছু হয়নি’ বলে এই ঘটনাকে ব্যাখ্যা করা বিপজ্জনক। প্রতিবাদ যাঁরা করতে চান, তাঁদের বক্তব্য জানানোর নানা সুযোগ ভারতীয় গণতন্ত্র দিয়েছে। সংসদ ভবনের বাইরে, এমনকি ভিতরেও কাগজে লিখে, মুখে বলে অনেক বার্তাই সরকারকে দেওয়া যায়। কিন্তু কতটা করা যায়, তারও একটা সীমা থাকা উচিত। এবং এই ঘটনা সেই সীমারেখার অনেকগুলিই অতিক্রম করে গিয়েছে। সংসদের মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থানে এমন কাণ্ড যাঁরা ঘটান কিংবা ঘটানোর পরিকল্পনা করেন, তাঁদের বড় শাস্তি কাম্য।
অবশ্য সেই শাস্তি আবশ্যিক ভাবে দেশদ্রোহ আইন কি না, কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন। এ ক্ষেত্রে বলার, যে সরকার সরকার-বিরোধিতাকেই দেশদ্রোহ মনে করে, কোনও সাংবাদিক সমালোচনামূলক সংবাদ লিখলেই, কিংবা কোনও সংবাদ-পরিক্রমামূলক তদন্ত করলেই মনে করে যে দেশদ্রোহ-মূলক আইন এনে তার মুখ চিরতরে বন্ধ করা যায়, সেই সরকারের আমলে সংসদের অভ্যন্তরে এমন আক্রমণমূলক কাজ যে ইউএপিএ দিয়েই মোকাবিলা করা হবে, তাতে আশ্চর্য কী! এও ঠিক যে, অপরাধের দিকে যদি সমাজের নজরটি বেশি ঘুরিয়ে দেওয়া যায়, তা হলে নিজেদের ব্যর্থতা এবং অপদার্থতার উপর কম আলো পড়ে। এক দিকে বিষয়টি কত ভয়ানক সেটা শাস্তির তীব্রতা দিয়ে বুঝিয়ে দেওয়া যায়, আর এক দিকে ঘটনার পিছনে সরকারি ব্যর্থতা কত ভয়ানক, সে বিষয় হিরণ্ময় নীরবতা পালন করেই কাজ চালানো যায়। এবং সাংসদরা যদি সে সব নিয়ে হইচই করেন, তা হলে তাঁদের সাময়িক ভাবে সংসদ থেকে বহিষ্কারও করা যায়। সব মিলিয়ে অপশাসনের এক আশ্চর্য নাট্যশালা হয়ে উঠেছে ভারতীয় সংসদ, বললে অত্যুক্তি হবে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy