সলিল চৌধুরী। ফাইল চিত্র।
একশোর থেকে সাতানব্বইয়ের দূরত্ব বেশি নয়, কিন্তু শতবর্ষের সঙ্গে তার তিন বছর আগের তফাত নিশ্চয় বিরাট। সলিল চৌধুরীকে নিয়ে এখনই অনেক উদ্যাপনের কথা নয়, ১৯২৫ সাল যখন তাঁর জন্মবর্ষ। তবে আগামী সময়ে তাঁকে নিয়ে, তাঁকে ঘিরে উদ্যাপন করার মতো মানসিকতা বাঙালি জীবনে অবশিষ্ট থাকবে কি না, সেই আশঙ্কা থেকে যায়। তিনি অসামান্য সুরকার, সঙ্গীত তাঁর হাতে জাদুমায়ার ছোঁয়া পায়, বলিউডে তিনি আজও বাঙালির গৌরবের আইকন। কিন্তু এ সবের উপরে যে তিনি সঙ্গীতকে জীবন ও জীবনের সংগ্রাম করে তুলেছিলেন, সলিল চৌধুরীর এই সমগ্রকে ধরার মতো হাতের প্রসার তখনও বাঙালির থাকবে কি না, সে বাস্তবিক এক বড় প্রশ্ন। অবশ্যই সলিল চৌধুরী একা নন, তাঁর সমসাময়িক অনেক মানুষ বাঙালির বিশ শতকে একটি দ্বিতীয় নবজাগরণ এনেছিলেন, এমন দাবি কখনও কখনও শোনা যায়। নিরপেক্ষ ইতিহাস বলবে, দাবিটি খুব অযৌক্তিক নয়। সত্যিই বাংলার সমাজ সংস্কৃতি শিল্প সাহিত্যে উনিশশো ত্রিশ ও চল্লিশের দশকে যে সাড়া পড়েছিল, তার যথেষ্ট ঐতিহাসিক স্বীকৃতি হয়তো আজও মেলেনি। আইপিটিএ বা ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘের আশি বছরে পদার্পণ ঘটল, এ-ও সামান্য কথা নয়। এই সঙ্ঘ এবং সমসাময়িক নানা সাহিত্য-শিল্প গোষ্ঠী সম্পূর্ণ নতুন একটা ভাবনার ঢেউ নিয়ে এসেছিল সেই সময়। দুনিয়া জুড়ে ফ্যাসিস্ট ক্ষমতার উত্থান, হিটলারের জার্মানিতে ক্ষমতাদখল ও পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ, মুসোলিনির একনায়কতন্ত্রী দাপট থেকে আবিসিনিয়া আক্রমণ, স্পেনের গৃহযুদ্ধ— সব মিলিয়ে উনিশশো ত্রিশের দশক এমন একটা ধাক্কা নিয়ে এল যে, বাঙালি মননশীল সমাজ তার অভিঘাতে কেঁপে উঠল, ফুঁসে উঠল এবং প্রতিবাদের নতুন ঘরানা তৈরি করে ফেলল। লখনউ-তে ১৯৩৬ সালে প্রগতি লেখক সঙ্ঘ প্রতিষ্ঠা হল, লিগ এগেনস্ট ফ্যাশিজ়ম অ্যান্ড ওয়ার-এর ভারতীয় শাখা তৈরি হল ১৯৩৭ সালে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলেন এই কমিটির সভাপতি। বিশিষ্ট সাহিত্যিক, শিল্পীদের সঙ্গে যোগ দিলেন প্রফুল্লচন্দ্রের মতো বিজ্ঞানীরাও। পরবর্তী কালে জার্মানির সোভিয়েট রাশিয়ার উপর আক্রমণ এবং জাপানের চিন আক্রমণকে ঘিরে উত্তাল হয়ে উঠল প্রতিবাদের স্বর ও সুর। ফ্যাসিস্টবিরোধী শিল্প সঙ্ঘের কার্যক্রম ছড়িয়ে পড়ল কলকাতা থেকে বাংলাদেশের অন্যত্র। এই সময়েই সলিল চৌধুরী, রবিশঙ্কর, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, হেমাঙ্গ বিশ্বাস সকলে যোগ দিলেন আইপিটিএ-র মতো সেই বৃহৎ কর্মকাণ্ডে, যেখানে এক দিকে আন্তর্জাতিক ঘটনার অভিঘাতে রচিত হচ্ছিল বহু গান-কবিতা, আর অন্য দিকে বাংলার ভয়াবহ মন্বন্তরের প্রেক্ষাপটে মানবতার আর্তি যথাসাধ্য ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছিল নানা প্রান্তের মানুষের মধ্যে।
সেই সময়ে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে শামিল ছিল সমগ্র ভারতই। দেশের নানা কোণে ঘটছিল অনেক ধরনের আন্দোলন। অসম অন্ধ্র মালাবার কর্নাটক যুক্তপ্রদেশ মহারাষ্ট্র পঞ্জাবের অসংখ্য শিল্পী কবি সাহিত্যিক তখন যুক্ত হয়েছিলেন বাংলার সঙ্গে— ভারতের সাংস্কৃতিক ইতিহাসেও এটি একটি অতি গুরুতর পর্ব। কিন্তু মানবতাবাদ, আন্তর্জাতিকতাবোধে ঋদ্ধ আন্দোলনের কথা ভাবলে, প্রশ্নাতীত যে বাংলাই তখন ছিল নেতৃত্বের স্থানে। বিশেষত সাংস্কৃতিক উদ্দীপনা টেনে নিয়ে যাওয়ার কাজে বাঙালি শিল্পী সাহিত্যিক কবি সঙ্গীতকাররা সে-দিন যে সক্রিয়তা ও সৃষ্টিশীলতা দেখিয়েছিলেন, তার তুলনা মেলা ভার। একই সঙ্গে সাধারণ মানুষও যথেষ্ট সাড়া দিয়েছিলেন এই কর্মকাণ্ডে। শিল্পী সঙ্ঘের অনুষ্ঠান হলে জনতার ভিড় উপচে পড়ত।
স্বাধীনতা-পরবর্তী কালেও বহু আন্তর্জাতিক, জাতীয় এবং স্থানীয় সঙ্কটের মুখোমুখি হয়েছে বাঙালি। কিন্তু কোনও তৃতীয় নবজাগরণ কিংবা আদৌ জাগরণের, সুদূর লক্ষণও দেখা যায়নি। বাস্তবিক এত শিল্পী সাহিত্যিক কবি লেখক সম্পাদক যে একত্র হয়ে কোনও গোষ্ঠী তৈরি করতে পারেন, এবং নানা বাইরের ও ভিতরের সঙ্কটের মধ্যে সেই গোষ্ঠী চালিয়ে নিয়ে যেতে পারেন, আজকের বাঙালিকে দেখলে তা বিশ্বাসও হতে চায় না। ইতিহাস নাকি ফিরে আসে, কখনও কখনও ট্র্যাজেডি হয়েই। কেবল অপশাসন ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে স্বার্থপ্রণোদিত লড়াইয়ে নয়, বৃহত্তর স্বার্থ-অতিক্রমী প্রতিবাদের ঘরানায় বাঙালির যে অতীত গৌরব, তার উত্তরাধিকার মিলতে পারে— অন্তত এখনও তেমন কোনও সুদূর ইঙ্গিত নেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy