নবদ্বীপের নাগরিকরা শেষ পর্যন্ত শহরের পুরপ্রধানের নির্দেশ, থুড়ি অনুরোধকে থোড়াই কেয়ার করেছেন, তা এক রকম ভরসা জোগায়। কিন্তু, পুরপ্রধান মহাশয়ের ‘অনুরোধ’টি চরিত্রে শুধু বেয়াড়া নয়, প্রবল বিপজ্জনক। সংখ্যাগরিষ্ঠের আধিপত্যের রাজনৈতিক বিপদ। দোল উপলক্ষে তিনি শহরে মাছ-মাংস বিক্রি বন্ধ রাখার ‘অনুরোধ’ করেছিলেন, কারণ ধর্মীয় অনুষ্ঠানের দিন পশুহত্যার দৃশ্যে মানুষের ভাবাবেগ আহত হতে পারে। তৃণমূল কংগ্রেস নেতৃত্ব পুরপ্রধানের এ-হেন মন্তব্যের দায় নিতে চাননি— একে পুরপ্রধানের ব্যক্তিগত মতামত বলেছেন— কিন্তু, একই রকম সত্য, দলীয় নেতৃত্ব পুরপ্রধানকে এ প্রশ্নও করেননি যে, কিছু মানুষের এমন ফঙ্গবেনে ভাবাবেগ আদৌ প্রশাসনিক শিরঃপীড়ার কারণ হবে কেন? অর্থাৎ, মতামতটি পুরপ্রধানের ব্যক্তিগত হতে পারে, কিন্তু তা দলের কাছে যথেষ্ট আপত্তিজনক নয়। সবচেয়ে বড় বিপদ এখানেই। হিন্দুদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে মাছ-মাংস বিক্রির উপরে নিষেধাজ্ঞা জারির অসংখ্য ঘটনা সাম্প্রতিক কালে ভারতে ঘটেছে। এবং, প্রায় ব্যতিক্রমহীন ভাবেই তা ঘটেছে বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলিতে। উদারবাদী রাজনীতি প্রতি বারই সেই নিষেধাজ্ঞার তুমুল সমালোচনা করেছে— তৃণমূল কংগ্রেসের কণ্ঠস্বর তাতে বরাবরই প্রবল। সেই তৃণমূলই যদি পশ্চিমবঙ্গের কোনও অঞ্চলে ধর্মীয় উৎসবে আমিষ নিষিদ্ধ করার আদেশ বা অনুরোধে আপত্তির কারণ খুঁজে না পায়, তা হলে স্পষ্ট হয় যে, বিজেপির সিদ্ধান্তের বিরোধিতা নিতান্তই রাজনৈতিক, আদর্শগত কোনও কারণে নয়। কেউ বলতে পারেন যে, তৃণমূলের অবস্থানটি বিপজ্জনকতর— কারণ, সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বেসাতি নিয়ে বিজেপির অন্তত কোনও রাখঢাক নেই। তারা যা করে, প্রকাশ্যে বুক বাজিয়ে করে।
নবদ্বীপের পুরপ্রধান যা করেছেন, তাকে ব্যতিক্রমী বললে অবশ্য অনৃতভাষণ হবে। নরম হিন্দুত্বের রাজনীতি তৃণমূল দীর্ঘ দিন ধরেই করে চলেছে। দিঘায় জগন্নাথ মন্দিরই হোক বা পাড়ার পুকুরে গঙ্গারতি, পশ্চিমবঙ্গ দেখে আসছে এই ঘটনাগুলিও, রাজ্যে বিজেপির ভোটবৃদ্ধির রেখচিত্রটির পাশাপাশি। নবদ্বীপ বিধানসভা কেন্দ্রে ২০২১ সালেও তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী জয়ী হয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর পক্ষে ভোট কমেছিল সাড়ে ৪ শতাংশের বেশি। তার চেয়ে বড় কথা, বিজেপির পক্ষে ভোট বেড়েছিল ৩০ শতাংশ। ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনে রানাঘাট কেন্দ্রে একমাত্র নবদ্বীপ বিধানসভা ক্ষেত্রে বিজেপি প্রার্থীর চেয়ে বেশি ভোট পেয়েছিলেন তৃণমূল প্রার্থী, কিন্তু সেই ব্যবধানও খুব বেশি নয়। অতএব, শাসক দলের শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোত নামলে তাকে অপ্রত্যাশিত বলা চলে না। নদিয়া জেলার জনসংখ্যায় মুসলমানদের অনুপাত প্রায় ২৭ শতাংশ— ফলে ধর্মীয় বিভাজনের রাজনীতির জন্য জেলাটি উর্বর ক্ষেত্র, সে কথাও অনস্বীকার্য। কিন্তু, ভারতীয় রাজনীতি সাক্ষী যে, হিন্দুত্বের খেলায় বিজেপিকে হারানো অসম্ভব। লোকে যদি হিন্দুত্বকেই বাছে, তা হলে বিজেপির আগমার্কা হিন্দুত্বকেই বাছবে, বিরোধী পক্ষের নরম হিন্দুত্ব নয়। ফলে, আমিষ বিক্রি বন্ধ করার মাধ্যমে সংখ্যাগুরু তোষণের যে পথ বাছা হল, সেটি আত্মঘাতী। কিন্তু, দলের বিপদের কথা দল ভাববে— রাজ্যের উদ্বেগের কারণটি বৃহত্তর। সঙ্কীর্ণ রাজনীতির স্বার্থে শাসক দল যদি মানুষের মৌলিক অধিকারে হস্তক্ষেপ করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে, তবে তা গভীরতর অন্ধকারের সূচনালগ্ন।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)