ঘৃণাই এখন এ দেশের প্রধান মুদ্রা। প্রতীকী ছবি।
অভিযুক্ত একটি আপত্তিকর বক্তব্য পেশ করেছিলেন, এবং সাংবিধানিক পদে আসীন একাধিক ব্যক্তির বিরুদ্ধে অপমানজনক শব্দ ব্যবহার করেছিলেন। সাম্প্রদায়িক সংঘাত তৈরির হুমকি দিয়েছিলেন, এবং তাতে উস্কানি দিয়েছিলেন। ধর্মের ভিত্তিতে একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের ভোট আদায়ের চেষ্টা করেছিলেন, এবং বিভিন্ন শ্রেণির মধ্যে বৈর তৈরির চেষ্টা করেছিলেন, যা আদর্শ নির্বাচনী বিধিভঙ্গের সমতুল।” সাংসদ ও বিধায়কদের বিচারের জন্য এক বিশেষ আদালতের এই রায়টি পড়লে অনেকের নামই মনে ভেসে উঠতে পারে। অভিযুক্তের নাম হতে পারে যোগী আদিত্যনাথ, যিনি বারে বারেই মনে করিয়ে দেন যে, মুসলমানরা এই ভারতে আসলে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক। অভিযুক্ত হতে পারেন নূপুর শর্মা, হজরত মহম্মদের নামে যাঁর অসম্মানজনক উক্তি গোটা বিশ্বে নিন্দা কুড়িয়েছিল। অভিযুক্ত হতে পারেন অনুরাগ ঠাকুরের মতো কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, যিনি প্রকাশ্যেই ‘গদ্দার’-দের গুলি মারার ডাক দেন। অভিযুক্ত হতে পারেন শুভেন্দু অধিকারী, যিনি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীকে অপমানজনক সম্বোধন করে বলেছিলেন, তাঁকে ভোট দিলে রাজ্য হবে ‘মিনি পাকিস্তান’। অথবা, অভিযুক্ত হিসাবে মনে পড়তে পারে সুদর্শন নিউজ়ের প্রধান সম্পাদক সুরেশ চাভাঙ্কের নাম, যিনি হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজনে অপরকে হত্যা করার শপথের কথা ঘোষণা করেছিলেন প্রকাশ্যে; মনে পড়তে পারে অভিনেত্রী কঙ্গনা রানাউতের কথা, যিনি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দমনের জন্য প্রধানমন্ত্রী মোদীকে ২০০০-এর দশকের গোড়ার দিকের ‘বিরাট রূপ’ পরিগ্রহ করতে আর্জি জানিয়েছিলেন; স্মরণে আসতে পারে গাজ়িয়াবাদের দসনা দেবী মন্দিরের প্রধান পুরোহিত জাতি নরসিংহানন্দের কথা, যিনি মুসলমানদের দমন করতে হিন্দুদের তরবারির চেয়েও আধুনিকতর অস্ত্র ধারণ করতে বলেছিলেন।
না, দেশের কোনও আদালতে এঁদের কারও শাস্তি হয়নি। তাঁদের প্রত্যেকের নামেই এফআইআর দায়ের করা হয়েছে, কিন্তু প্রায় ব্যতিক্রমহীন ভাবেই বিচারপ্রক্রিয়া আর অগ্রসর হয়নি। রামপুরের বিশেষ আদালত যাঁর তিন বছরের কারাদণ্ড ঘোষণা করল, তিনি সমাজবাদী পার্টির বিধায়ক আজ়ম খান। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের প্রচারপর্বে তিনি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সম্বন্ধে আপত্তিকর মন্তব্য করেছিলেন বলে অভিযোগ। অন্যায় করলে তার শাস্তি হওয়াই বিধেয়। আপাতত আজ়ম খান জামিন পেয়েছেন, তিনি উচ্চতর আদালতে আপিল করবেন। সেই আদালতে বিচারপ্রক্রিয়া দ্রুত হওয়াই কাম্য— অপরাধ প্রমাণ হলে তাঁর শাস্তিও হোক। কিন্তু, দেশের বিচারব্যবস্থার প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা বজায় রেখেও প্রশ্ন করা প্রয়োজন, ভারতে কি কোনও একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের সদস্য বা সমর্থক হলে ঘৃণাভাষণ আর শাস্তিযোগ্য অপরাধ নয়? কয়েক দিন আগেই সুপ্রিম কোর্টের দুই বিচারপতি কে এম জোসেফ ও হৃষীকেশ রায় খেদোক্তি করেছিলেন, ধর্মের নামে দেশ কোথায় পৌঁছেছে! কেন ভারত এই জায়গায় পৌঁছল, তার কারণ সন্ধানে বিচারবিভাগের আত্মসমীক্ষার প্রয়োজন রয়েছে কি না, মহামান্য শীর্ষ আদালত তা ভেবে দেখতে পারে। তবে, যা নিয়ে সংশয়ের তিলমাত্র অবকাশ নেই, তা হল, ভারতে ক্ষমতাসীন গৈরিক জাতীয়তাবাদীরা ঘৃণাভাষণকে কার্যত ‘স্বাভাবিক’ করে তুলেছেন। অযোধ্যার মসজিদ ধ্বংসের পর যখন ‘কাশী, মথুরা বাকি হ্যায়’ স্লোগান উঠেছিল, তখন ধাক্কা লেগেছিল— মনে হয়েছিল, এ কোন ভারতের কথা উচ্চারণ করছে রাজনীতি! এখন অনুরাগ ঠাকুর, নূপুর শর্মাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক ঘৃণাভাষণে আর অবাক লাগে না। কত নীচে নামা সম্ভব, সেই প্রশ্নটি এখনও জাগে বটে, কিন্তু আশঙ্কা হয়, সেই অতলও আর ভারতের মানুষকে বিচলিত করতে পারবে না। ঘৃণাই এখন এ দেশের প্রধান মুদ্রা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy