Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
West Bengal Panchayat Election 2023

খয়রাতির উপাদান

দায় যারই হোক, কোনও ক্ষেত্রেই কি ক্ষতিপূরণ হিসাবে সরকারি চাকরি দেওয়া চলে? সে চাকরির বেতন সরকার জোগায় বটে, কিন্তু সে টাকা জনগণের।

An image of Job

—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

শেষ আপডেট: ২২ নভেম্বর ২০২৩ ০৭:৩৩
Share: Save:

পঞ্চায়েত নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ঘটা হিংসায় নিহতদের পরিবারপিছু এক জনকে ক্ষতিপূরণ বাবদ চাকরি দেবে রাজ্য সরকার, এমন সিদ্ধান্তের কথা শোনামাত্র প্রশ্ন উঠতে আরম্ভ করেছে। যেমন, এই চাকরি কি শুধু শাসক দলের নিহত কর্মী-সমর্থকদের পরিবারের সদস্যরাই পাবেন? প্রশ্নটি অপরিহার্য, কারণ পঞ্চায়েত নির্বাচনকেন্দ্রিক হিংসায় মৃতের সংখ্যা কত, সে বিষয়ে রাজ্য প্রশাসন ও শাসক দলের সঙ্গে বিরোধীপক্ষের হিসাব মেলেনি। শাসক দলের তালিকায় স্বভাবতই বিরোধীদের সংখ্যা— বিরোধীদের দাবির তুলনায়— কম। মৃতদেহ যখন রাজনীতির উপকরণ, তখন এই গরমিল থাকবেই। দ্বিতীয় প্রশ্ন, লোকসভা ভোটের মুখে এই চাকরি কি দুর্নীতির আরও একটি পথ খুলে দেবে? পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক অর্থনীতিতে এই প্রশ্নটিও অনিবার্য। তৃতীয়ত, ‘নির্বাচনী হিংসায় নিহত’— এই মাপকাঠিটিকে নৈর্ব্যক্তিক বলা মুশকিল, কারণ কোন মৃত্যুর কারণ ‘নির্বাচনী হিংসা’ আর কোনটি নয়, তা নির্ধারণ করে প্রশাসন, এবং এ রাজ্যে তার একমেবাদ্বিতীয়ম্ চালিকাশক্তি হল রাজনীতি। চতুর্থ প্রশ্ন, বিরোধী রাজনৈতিক দলের হামলায় মৃত্যু আর দলীয় গোষ্ঠী কোন্দলে মৃত্যু কি সমান গুরুত্বে বিবেচিত হবে? কেউ কেউ আশঙ্কা প্রকাশ করছেন, এই ক্ষতিপূরণের ঘোষণাটি আসলে শাসক দলের কর্মীদের জন্য একটি বিমা তথা প্রণোদনা প্রকল্প— মারা গেলে পরিবারের কারও সরকারি চাকরি জুটবে, এই ভরসায় হয়তো আরও অনেকে নির্বাচনী সন্ত্রাসে আগ্রহী হয়ে উঠবেন।

এই প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক প্রশ্নগুলির পরে রয়েছে প্রশাসনিক নৈতিকতার প্রশ্ন। সরকার তখনই ক্ষতিপূরণ দিতে পারে, যখন ক্ষতিটি প্রশাসনিক গাফিলতির কারণে হয়। অর্থাৎ, প্রশাসন যথেষ্ট তৎপর হলে যে ক্ষতি এড়ানো সম্ভব হত, সে ক্ষেত্রেই ক্ষতিপূরণ দেওয়া নৈতিক। অতএব, রাজ্য প্রশাসনের কাছে প্রশ্ন করা প্রয়োজন, নির্বাচনী হিংসাকে কি প্রশাসনিক গাফিলতি হিসাবেই দেখা হচ্ছে? যদি তা-ই হয়, তবে শুধু ক্ষতিপূরণেই বিষয়টি মিটে যায় না। নির্বাচন-পূর্ব সময়ে আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখার দায়িত্ব যাঁদের উপর ন্যস্ত ছিল, তাঁদের গাফিলতির বিচার হওয়া জরুরি। এবং জরুরি শাস্তিবিধান। নির্বাচনের পরে বেশ কয়েক মাস কেটে গিয়েছে। এখন অবধি ক’টি ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট থানার আধিকারিকের বিরুদ্ধে কর্তব্যে অবহেলার অভিযোগে তদন্ত হয়েছে? ক’টি জেলার পুলিশকর্তা প্রশ্নের মুখে পড়েছেন; ক’জন বিডিও, মহকুমা শাসক বা জেলা শাসকের বিরুদ্ধে তদন্ত হয়েছে? উত্তরটি রাজ্যবাসী জানেন। ফলে, ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ক্ষেত্রে যদি দুর্নীতি বা রাজনৈতিক রং বিচার না-ও হয়, তবুও তা প্রশাসনের গাফিলতি ঢাকা দেওয়ার অপপ্রয়াস মাত্র। আর, যদি এটি প্রশাসনিক গাফিলতি হিসাবে বিবেচিত না হয়, তবে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দায় বা অধিকারও সরকারের নেই। যে দল হিংসা করেছে, ক্ষতিপূরণও তাদেরই দিতে হবে। তাদের বাধ্য করতে হবে দিতে।

পরের প্রশ্নটি ক্ষতিপূরণের চরিত্র নিয়ে। দায় যারই হোক, কোনও ক্ষেত্রেই কি ক্ষতিপূরণ হিসাবে সরকারি চাকরি দেওয়া চলে? সে চাকরির বেতন সরকার জোগায় বটে, কিন্তু সে টাকা জনগণের। তার চেয়েও বড় কথা, চাকরির একটি দিক যেমন মাসমাইনে বা অন্যান্য সুবিধা, তার অন্য দিকটি হল জনপরিসরে পরিষেবা। সেই পরিষেবা প্রদানের জন্য যোগ্যতা প্রয়োজন হয়— যে স্তরের চাকরি, সেই স্তরের যোগ্যতা, কিন্তু যোগ্যতার প্রমাণ ব্যতিরেকে চাকরি দেওয়া চলে না। যাঁরা ক্ষতিপূরণ বাবদ চাকরি পাবেন, তাঁরা যোগ্যতার প্রমাণ ব্যতিরেকেই পাবেন। অর্থাৎ, সেই পদগুলির দ্বারা আগামী বেশ কয়েক বছর কাঙ্ক্ষিত পরিষেবা পাওয়া যাবে কি না, তার নিশ্চয়তা নেই। কেউ বলতে পারেন, এ রকম চাকরির সংখ্যা নগণ্য। কিন্তু, প্রশ্নটি সংখ্যার নয়, নীতির। সরকারকে যদি ক্ষতিপূরণ দিতেই হয়, তবে বিকল্প পথের সন্ধান করতে হবে। রাজ্য সরকারের চাকরি খয়রাতির উপাদান নয়।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy