Advertisement
E-Paper

প্রচারকুশলী

হিন্দুরা শরণার্থী এবং মুসলমানরা অনুপ্রবেশকারী, এই সমীকরণ জনমনে প্রোথিত করে দিতে পেরেছেন মোদী-শাহ নেতৃত্ব।

শেষ আপডেট: ০১ এপ্রিল ২০২৫ ০৬:২১
Share
Save

পশ্চিমবঙ্গের যদি ভোট আসন্ন হয়, অথচ দলীয় সংগঠনের পরিস্থিতি হয় হতাশাজনক, তা হলে ভারতীয় জনতা পার্টির পক্ষে যে কাজটা করা সবচেয়ে স্বাভাবিক ও সবচেয়ে সহজ, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ আবার সেটাই করলেন। আরও এক বার, সজোর হুঙ্কার দিলেন যে, এই রাজ্যে অনুপ্রবেশ আটকানোর জন্যই ২০২৬ সালে বিজেপির ক্ষমতায় আসা জরুরি। অনুপ্রবেশ নিয়ন্ত্রণ কথাটির মানে সাধারণ ভাবে যা-ই হোক না কেন, বিজেপিকুলতিলকদের দৌলতে শব্দটির অর্থ হয়ে গিয়েছে ‘মুসলমান বিতাড়ন’। হিন্দুরা শরণার্থী এবং মুসলমানরা অনুপ্রবেশকারী, এই সমীকরণ জনমনে প্রোথিত করে দিতে পেরেছেন মোদী-শাহ নেতৃত্ব। পাশাপাশি, অনুপ্রবেশ স্লোগানের প্রসারিত অর্থ— ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেস সরকার ‘মুসলমান তোষণ’ করে, অর্থাৎ নাকি পরোক্ষে, কিংবা প্রত্যক্ষেই, অনুপ্রবেশে মদত দিয়ে থাকে, তাই এই রাজ্যে রাজনৈতিক দ্বিত্ব বা বাইনারি তৈরির কাজটি বিজেপির দর্শনে অতি সহজ ও সরল। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী অঞ্চলে চলাচল ও পারাপারে দীর্ঘ ও জটিল ইতিহাস এই ভাবেই প্রথমত হিন্দু-মুসলমান, ও ফলত বিজেপি-তৃণমূল, এই দুই রকম দ্বিত্বে সরলীকৃত হয়েছে।

বলতেই হবে যে, এই দ্বিত্ব-তৈরির কাজটিতে তাঁরা সাফল্যও পেয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গের নাগরিক সমাজের এক বড় অংশ সংখ্যালঘু-বিরোধিতায় এতই তৎপর ও আগ্রহী যে, তাঁদের মধ্যে অনুপ্রবেশ সংক্রান্ত হিন্দুত্ববাদী প্রচার এমনিতেই বিশেষ জনপ্রিয়। তদুপরি গত বছর অগস্ট থেকে বাংলাদেশ সঙ্কটের আবহে তা যেন ক্রমবর্ধমান। অথচ সহজ বুদ্ধিতেই বোঝা যায়, বাংলাদেশে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অভ্যুত্থান ও তৎপরবর্তী ইসলামি শক্তির ক্ষমতার্জন ও সংখ্যালঘু বিপন্নতার প্রেক্ষিতে নতুন করে যদি সীমান্ত পারাপার বেড়ে গিয়ে থাকে, তবে, বিজেপির ভাষা ধার করে বলা যায়, ‘মুসলমান অনুপ্রবেশকারী’দের থেকে ‘হিন্দু শরণার্থী’দের সংখ্যাই সেখানে বেশি হওয়ার কথা। অমিত শাহ বলছেন, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার নাকি এই মুহূর্তে ইচ্ছা করেই ভারত বাংলাদেশ সীমান্তে কাঁটাতার লাগাতে দিচ্ছে না। এই কথা যদি সত্যি হয়, তা হলে কাদের স্বার্থ এতে বেশি রক্ষিত হওয়ার কথা, ‘নিপীড়িত’ হিন্দুদের না কি ‘সুযোগসন্ধানী’ অহিন্দুদের, হিসাবটা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কষে দেখেছেন কি? অবশ্য অঙ্কটা কষলেও সমর্থক সমাজকে সেটা না বলাই হল দস্তুর। রাজনৈতিক স্লোগান বহুলাংশে ভর করে থাকে জনসাধারণের বোধবুদ্ধির ন্যূনতার বিবেচনার উপর— বিজেপি মন্ত্রীর সাম্প্রতিকতম রাজনৈতিক প্রচারটি তার উপযুক্ত দৃষ্টান্ত।

এক দিকে বোধবুদ্ধির ন্যূনতার উপর ভরসা, অন্য দিকে তবে তথ্যের অপর্যাপ্ত ধারণার আশ্রয়। অনুপ্রবেশের ফলে মুসলমান জনসংখ্যা এই রাজ্যে দ্রুত বাড়ছে বলে যে প্রচার, তা কতখানি ভিত্তিহীন ও রাজনৈতিক স্বার্থপ্রসূত, গবেষকরা তা দেখিয়েছেন। পরিসংখ্যান বলছে, অনুপ্রবেশের ফলে পশ্চিমবঙ্গে মুসলমান জনসংখ্যা তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে বৃদ্ধি পায়নি, বরং যতটুকু বেড়েছে তা ঘটেছে দারিদ্র বা অশিক্ষার মতো কারণে। বাস্তবিক, ২০০১ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে মুসলমান জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার ২৫.৯ শতাংশ থেকে কমে হয় ২১.৮ শতাংশ, আর ওই একই সময়ে হিন্দুদের বৃদ্ধির হার কমে দাঁড়ায় ১৪.২ শতাংশ থেকে ১০.৮ শতাংশ। বিপুল পরিমাণে অনুপ্রবেশকারী রাজ্যে প্রবেশ করলে সংখ্যা অন্য রকম দাঁড়াত। সীমান্তবর্তী জেলাগুলির মধ্যে কয়েকটিতে মুসলমান জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার বেশি, কিন্তু সেই সব জেলায় হিন্দু জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারও বেশি, যা বলে দেয়, ধর্মের কারণে নয়, আসলে দারিদ্র ও অশিক্ষার কারণেই বৃদ্ধির হারে স্থানিক তারতম্য ঘটছে। কথাগুলি খুব জটিল নয়। কিন্তু রাজনৈতিক নেতারা যদি প্রলয় ঘটানোর উদ্দেশ্যে মানুষকে অন্ধ করেই রাখতে চান, তাঁদের ঠেকানোর সাধ্য কার?

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Intruder Immigrants BJP TMC

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}