Advertisement
E-Paper

লোকই নেই, রাতের বাসে হানা দেবে কে

অভিযান চানানোর লোকবল নেই। বেহাল পরীক্ষাগারের পরিকাঠামো। জাল ওষুধের মামলার জন্য ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টও নেই। ফলে অনায়াস কারবার।

— প্রতীকী চিত্র।

শান্তনু ঘোষ

শেষ আপডেট: ০১ এপ্রিল ২০২৫ ০৭:২২
Share
Save

ভিন্‌ রাজ্যের সীমানা পার করে এ রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় ঢুকছে জাল ওষুধ। সেখান থেকে রাতের বাসে তা পৌঁছচ্ছে কলকাতায়। কিন্তু সেই খবর থাকার পরেও গোড়াতেই আটকানো যাচ্ছে না কেন? আমতার ঘটনার পরে জাল ওষুধ ধরতে রাজ্য ড্রাগ কন্ট্রোল বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালিয়ে সাফল্য পেলেও প্রশ্ন উঠছে, রাজ্যের প্রতিটি প্রান্তে কয়েক কোটি টাকার যে জাল ওষুধ ছড়িয়ে পড়েছে, তা ধরার মতো পরিকাঠামো কি আদৌ রয়েছে এ রাজ্যে?

প্রকাশ্যে এ বিষয়ে রাজ্য ড্রাগ কন্ট্রোলের কেউ মুখ খুলতে চাননি। তবে, ওষুধের ব্যবসায়ীদের একাংশ বলছেন, “ব্যাপারটা অনেকটাই ‘ইচ্ছা থাকলেও হাত-পা বাঁধা, তাই উপায় নেই’-র মতো অবস্থা। কার্যত ঢাল-তরোয়ালবিহীন নিধিরাম সর্দারের মতো করেই চলছে পুরো ব্যবস্থা।” শুধু রাজ্য নয়, পরিকাঠামোর অভাব রয়েছে ‘সেন্ট্রাল ড্রাগস স্ট্যান্ডার্ড কন্ট্রোল অর্গানাইজ়েশন’ (সিডিএসসিও)-র পূর্বাঞ্চলীয় শাখাতেও। একই সঙ্গে এ বিষয়ে মামলার বিচারের জন্য এ রাজ্যে নির্দিষ্ট আদালত বা ফাস্ট ট্র্যাক কোর্ট নেই। ওই মামলার জন্য নির্দিষ্ট সরকারি কৌঁসুলিও নেই। ফলে দীর্ঘসূত্রিতার জন্য জাল ওষুধের কারবারে অভিযুক্ত ধরা পড়লেও, একটা সময়ের পরে জামিনে মুক্তি পেয়ে যাচ্ছে। আর, মামলা চলতে থাকছে বছরের পর বছর ধরে।

ড্রাগ কন্ট্রোলের প্রাক্তন কর্তাদের অনেকের দাবি, অবসর নেওয়ার পরেও বিচারাধীন তাঁদের সময়ের মামলা। কোনও ক্ষেত্রে ৮-১০ বছর ধরে বিচার চললেও, অভিযুক্তই মারা গিয়েছে। পরিকাঠামোর বিরাট খামতি রয়েছে রাজ্যের ড্রাগ কন্ট্রোল অ্যান্ড রিসার্চ ল্যাবরেটরিতেও।

গত ফেব্রুয়ারিতে আমতার পাইকারি ব্যবসায়ীর গুদামে হানা দিয়ে তাঁকে গ্রেফতার, এবং সেই সূত্র ধরে এখনও পর্যন্ত প্রায় তিন কোটি টাকার জাল ওষুধ বাজেয়াপ্ত করেছে রাজ্য ড্রাগ কন্ট্রোল। কিন্তু এমন অসংখ্য ব্যবসায়ী রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। যাদের হাত ধরে রাজ্যের বাজারে কয়েক কোটি টাকার জাল ওষুধের রমরমা চলছে। তা ধরতে পরিকাঠামো যে পর্যাপ্ত নয়, তা বোঝা যায় স্বাস্থ্য দফতরের ড্রাগ কন্ট্রোল বিভাগের অন্দরে ঢুঁ মারলেই। সূত্রের খবর, রাজ্য ড্রাগ কন্ট্রোলে এ মুহূর্তে ইন্সপেক্টর এবং সিনিয়র ইন্সপেক্টর মিলিয়ে ৫২টি পদ খালি। নজরদারির জন্যে তেমন ভাবে কোনও গাড়ি নেই। আর জেলাগুলিতে নিজস্ব গাড়ি নেই। কোথাও অভিযান করতে হলে গাড়ি ভাড়া করতে হয়। প্রশ্ন হল, রাতের বাসে সীমানা পেরিয়ে ওষুধ ঢোকার ক্ষেত্রে নজরদারি কি এইপরিকাঠামোয় সম্ভব?

এ ছাড়া, রাজ্য ড্রাগ কন্ট্রোলে চার বছর ধরে পূর্ণ সময়ের জন্য কোনও অধিকর্তা নেই। স্বাস্থ্য দফতরের এক সচিবকে ওই অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া রয়েছে। প্রায় ৪০ শতাংশ শূন্য পদ থাকলেও ২০১৮-র পরে নতুন নিয়োগও হয়নি। অথচ কেন্দ্র এবং রাজ্য দু’ক্ষেত্রেই এক জন ড্রাগ ইন্সপেক্টরকে নতুন দোকানকে লাইসেন্স দেওয়ার আগে পরিদর্শন, লাইসেন্স রিনিউ, নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষায় পাঠানো, ব্লাড ব্যাঙ্ক পরিদর্শন, প্রস্তুতকারী সংস্থায় পরিদর্শন, নজরদারি, আদালত-পুলিশ সব সামলাতে হয়। একই অবস্থা ‘সিডিএসসিও’-র পূর্বাঞ্চলীয় শাখাতেও। এ রাজ্যের পাশাপাশি বিহার, ওড়িশা, ঝাড়খন্ড, সিকিম এবং আন্দামান-নিকোবর ওই জ়োনের অধীনে রয়েছে। অথচ ইন্সপেক্টর মাত্র চার জন। ড্রাগ কন্ট্রোলের আধিকারিকদের অনেকেই জানাচ্ছেন, অভিযান বা তল্লাশির জন্য নির্দিষ্ট কোনও পুলিশি ব্যবস্থা নেই। নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক এক আধিকারিকের কথায়, ‘‘জাল ওষুধ তৈরিতে যারা যুক্ত, তারা দুষ্কৃতী। আমাদের পক্ষে কী ভাবে তাদের ডেরায় হানা দিয়ে হাতেনাতে ধরা বা নজরদারি করা সম্ভব?’’

গত ডিসেম্বরে একটি নামী প্রস্তুতকারী সংস্থার নজরদারি দল রাজ্য ড্রাগ কন্ট্রোলকে খবর দেয়, তাদের তৈরি রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের ওষুধ জাল হয়ে বাজারে ঘুরছে। এরপরে শহরের কয়েকটি পাইকারি দোকানে হানা দিয়ে নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য পাঠায় রাজ্য ড্রাগ কন্ট্রোল। ফেব্রুয়ারিতে রিপোর্ট আসার পরে ওই সমস্ত দোকানের সূত্র ধরে আমতায় অভিযান চালানো হয়েছিল। সূত্র বলছে, এ ক্ষেত্রে রিপোর্ট আসতে মাস দেড়েক মতো লাগলেও রাজ্যের ড্রাগ কন্ট্রোল অ্যান্ড রিসার্চ ল্যাবরেটরির বেহাল পরিকাঠামোর জন্যঅধিকাংশ ক্ষেত্রেই অনেক দেরি হয় চূড়ান্ত রিপোর্ট পেতে। তাতে তদন্তের অগ্রগতিতে সমস্যাও হয় অনেক। কারণ, কোনও ওষুধ বাজেয়াপ্ত করার সময়ে ‘এই ওষুধটি জাল বলে সন্দেহ করছি’ বলে লিখতে হয় ড্রাগ কন্ট্রোলের আধিকারিকদের। কারণ, রিপোর্ট না আসা পর্যন্ত চূড়ান্ত ভাবে বলা সম্ভব হয় না।

এ দিকে রাজ্য পরীক্ষাগার রয়েছে মাত্র একটি। যেখানে ২০১৪ থেকে পূর্ণ সময়ের জন্যে কোনও আধিকারিক নেই। ওষুধের পাশাপাশি পুলিশের বাজেয়াপ্ত করা মাদকও পরীক্ষা হয় ওই পরীক্ষাগারেই। ৪৭টি অনুমোদিত পদ থাকলেও মাত্র ১২ জন টেকনিশিয়ানকে নিয়েই কাজ চালানো হচ্ছে। সূত্রের খবর, প্রতি মাসে ওষুধ ও মাদকদ্রব্য মিলিয়ে ৭০০-৮০০ নমুনা আসে। যদিও লোকবলের অভাবে পরীক্ষা করা সম্ভব হয় ৩০-৪০ শতাংশ। উত্তরবঙ্গে একটি পরীক্ষাগার তৈরির কথা থাকলেও তা হয়নি। রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরের এক কর্তার আশ্বাস, ‘‘ড্রাগ কন্ট্রোলের নতুন অফিস থেকে শুরু করে, নতুন উন্নত মানের ল্যাবরেটারি তৈরি, লোকবল বাড়ানোরও পরিকল্পনা করা হয়েছে।’’

প্রশ্ন, আর হবে কবে?

(চলবে)

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Illegal Medicines Fake Medicines police investigation Police Raid

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}