ফাইল চিত্র।
গণতন্ত্রের স্বাস্থ্য বজায় রাখিবার জন্য প্রশ্নের অধিকার, প্রতিবাদের অধিকার অপরিহার্য। কেবল গণতন্ত্রেরই কেন, ধর্ম ও সমাজের স্বাস্থ্যও নির্ভর করে প্রশ্নশীলতার উপর। এই প্রশ্নশীলতার উৎস কোথায়? যদিও বর্তমান ভারতে মুখ খুলিলেই দেশদ্রোহী বলিয়া চিহ্নিত হইবার প্রভূত সম্ভাবনা, ‘সনাতন’ ভারতে প্রশ্নের অধিকার স্বীকৃত ছিল। কাজেই ভারতীয় আদালত ‘প্রশ্নশীলতা মাত্রই দেশদ্রোহ নহে’, এই কথা মনে করাইয়া ভারতীয়-সংস্কৃতির যথার্থ রক্ষকের ভূমিকা পালন করিয়াছে। সমাজ, ধর্ম কিংবা রাষ্ট্র বিষয়ে যাঁহারা প্রশ্ন তুলিতেছেন তাঁহারা সচেতন বলিয়াই প্রশ্ন তুলিতেছেন। অর্থাৎ প্রশ্নশীলতার অর্থ বিরোধিতা নহে, যিনি প্রশ্ন করিতেছেন তিনি শত্রু নহেন— বরং বলা যাইতে পারে তিনি মিত্র-বিশেষ। মিত্র তো বাবুর পদতলে সোহাগ-মদে দোদুল কলেবর তোষামুদে হইবেন না। তোষামুদেদের লইয়া ফুর্তি করা চলে, নিজের চিত্তের বিকাশ সাধনে তাহাদের ভূমিকা নেতিবাচক। প্রকৃত গণতন্ত্রে যেমন সচেতন নাগরিকদের কদর বেশি তেমনই যে ধর্ম, যে সমাজ বিকাশকামী, তাহারা বিরুদ্ধ মতকে সমাদর করে, ঠাঁই দেয়। শুধু তাহাই নহে, বিরোধী-মতকে প্রয়োজনমতো গ্রহণ করিয়া নিজের রূপান্তর ঘটায়। কথাটি নানা কালের নানা ভারতীয় চিন্তকের ভাবনায় প্রকাশিত।
দার্শনিক বিমলকৃষ্ণ মোতিলাল মহাভারতের অন্তর্গত নৈতিক-দোলাচলতার বিষয়টিকে বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করিয়াছিলেন। এই দোলাচলতা প্রকৃতপক্ষে প্রশ্নশীলতারই এক রূপ। তাঁহার অভিমত: এই প্রশ্নশীলতার সূত্র-ধরিয়াই ভারতবর্ষে অজস্র মহাভারত রচিত হইয়াছে। ভারতবর্ষ নানা মহাভারতের দেশ, নানা রামায়ণেরও দেশ। যেখানেই নৈতিক-দোলাচলতা সেখানে একটি পন্থাকে কেহ মানিয়া লইতে চাহিবেন, ইহাতে অবশ্য অপর-পন্থাটির প্রাসঙ্গিকতা হারাইয়া যাইতেছে না। মহাভারতেও অপর-পন্থা প্রাসঙ্গিকতা হারায় নাই। অপর পন্থাটির গুরুত্ব বুঝিয়া কেহ সেই সূত্র হইতে মহাভারতের আর একটি সংস্করণ নির্মাণ করিতে পারেন। নূতন রূপটিও কিন্তু মহাভারতের ঐতিহ্যেরই অন্তর্গত। এই ভাবেই ভারতে নানা মহাভারতের মহানদী ও শাখানদী প্রবাহিত হইয়াছে। কঠোপনিষদে নচিকেতা পিতার কাজে খুশি হইতে পারেন নাই। তাঁহার পিতা গোদান করিতেছিলেন বটে, তবে সেই গরুগুলি কৃশ, তাহারা আর ঘাস খাইবে না দুগ্ধও প্রদান করিবে না। অথচ, এই কৃশকায় গরুগুলিকে দান করিয়াই পিতা দানশীল বলিয়া খ্যাতিমান হইতে তৎপর। অতঃপর পিতৃকার্যে বিরক্ত নচিকেতা বারংবার প্রশ্ন করিতে থাকেন, “হে পিতা আমাকে আপনি কাহাকে দান করিলেন?” অবশেষে তিতিবিরক্ত পিতা নচিকেতাকে মৃত্যুর দেবতা যমের নিকট দান করেন। যমের নিকট আসিয়াও নচিকেতা তাঁহার প্রশ্নশীল মন হারাইয়া ফেলেন নাই। আত্মতত্ত্ব লইয়াই যম-নচিকেতা সংবাদ।
এই সকল ভারতীয় ঐতিহ্য সঙ্কীর্ণ হিন্দুত্ববাদীদের থাকিয়া থাকিয়াই মনে করাইয়া দিতে হয়। কারণ, ভারত-সংস্কৃতি বলিতে তাঁহারা একের পক্ষপাতী। সেই একের দাপটে নানাত্বকে খর্ব করিবার রাজনৈতিক মূঢ়তা এ-দেশে সাম্প্রতিক অতীতে ও বর্তমানে ক্রমাগতই দৃষ্টিগোচর হইতেছে। ‘ভারতীয়’ বলিয়া যে বৈচিত্রহীনতার তাঁহারা পক্ষপাতী, তাহাই আদতে চূড়ান্ত অর্থে অভারতীয়। বিপক্ষ-দমনের রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রনৈতিক কৌশল প্রয়োগে তাঁহারা সদা তৎপর। আশার কথা ইহাই যে, ভারতীয় গণতন্ত্রের অপর ক্ষেত্রগুলিকে তাঁহারা সম্পূর্ণ গ্রাস করিতে পারেন নাই। বিচারবিভাগ তাহার উজ্জ্বল উদাহরণ। বহু ক্ষেত্রেই বিচারালয়ের সতর্কবার্তা কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি নিক্ষিপ্ত হইতেছে। শাসকবৃন্দ অগত্যা মানিয়া লইতেছেন। বিচারের বাণী নীরবে-নিভৃতে অশ্রুবর্ষণের নিয়তি মানিয়া লইবার দুর্ভাগ্য হইতে কিছুটা হইলেও মুক্ত। এই পরিস্থিতিতে হতাশাগ্রস্ত হইলে চলিবে না। যাঁহারা প্রশ্নপরায়ণ সচেতন নাগরিক তাঁহাদের আত্মবিশ্বাস বজায় রাখিতে হইবে। তাঁহারা দেশের শত্রু নহেন, বরং তাঁহারাই দেশের যথার্থ মিত্র। হিন্দুত্বের সঙ্কীর্ণতা ক্ষণকালের, আজ আছে কাল নাই। ভারত ইতিহাসের ধারা ভারত সংস্কৃতির ঐতিহ্য বহুকাল ধরিয়া বহমান। সেই ঐতিহ্য প্রশ্নশীলতার, পরিপ্রশ্নের, সচেতনতার। সচেতন প্রশ্নশীলকে ভারত চিরকালই আপন করিয়া লইয়াছে। যে বুদ্ধদেব বৈদিক কর্মবাদকে প্রশ্ন করিয়াছিলেন, সেই বুদ্ধদেব দশাবতারের তালিকায় স্থান পাইয়াছেন। অতঃপর এক্ষণে প্রশ্নশীলগণের প্রতি রাষ্ট্রীয় মনোভাব যাহাই হউক না কেন ভবিষ্য-ভারতে তাঁহারাই হয়তো দেশবন্ধুর স্বীকৃতি পাইবেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy