—ফাইল চিত্র।
রাম মন্দিরে বিগ্রহের প্রাণপ্রতিষ্ঠা অনুষ্ঠানে কংগ্রেস নেতৃত্বকে আমন্ত্রণ পাঠানো দাবার বোর্ডে কিস্তিমাতের চাল ছিল। কংগ্রেস নেতারা তাতে যোগ দিলে দলের ধর্মনিরপেক্ষ বহুত্ববাদী অবস্থানে বড় মাপের ধাক্কা লাগত। ভুললে চলবে না যে, এই মন্দিরের ভিতে রয়েছে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের বর্বরতা— অনুষ্ঠানে যোগ দিলে সেই পাপের দায়ভাগ কংগ্রেসের উপরেও বর্তাত। বহু ভাবনাচিন্তার পর কংগ্রেস আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করায় বিজেপি তাদের ‘হিন্দু-বিরোধী’ বলে দেগে দিয়েছে; একাধিক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ‘কংগ্রেসের স্বরূপ উন্মোচিত হল’ মর্মে বক্তব্য পেশ করেছেন। রাম মন্দিরকে যে বিজেপি নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে সব রকম ভাবে ব্যবহার করবে, তা অনুমান করার জন্য কৃতিত্ব দাবি করা অনর্থক, নিতান্ত কাণ্ডজ্ঞান থাকলেই কথাটি বোঝা যায়। কিন্তু, তার পরও কিছু প্রশ্ন থাকে। প্রথম প্রশ্ন, রাম মন্দিরের সঙ্গে বিজেপি বা আরএসএস-এর সম্পর্ক কোথায়? হ্যাঁ, ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর যে করসেবকরা মসজিদ ভেঙেছিলেন, তাঁরা অযোধ্যায় পৌঁছেছিলেন লালকৃষ্ণ আডবাণী, মুরলীমনোহর যোশী, উমা ভারতী প্রমুখ বিজেপি নেতা-নেত্রীর আহ্বানে। কিন্তু, অযোধ্যার জমিসংক্রান্ত মামলাতেও বিজেপি বা আরএসএস অংশগ্রহণকারী পক্ষ নয়, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে মন্দির তৈরির জন্য যে অছি পরিষদ গঠিত হয়, তাতেও তারা ভাগীদার নয়। রাম মন্দিরের সঙ্গে বিজেপির মূল সম্পর্ক, তারা এই প্রশ্নটিকে দীর্ঘ দিন ধরে রাজনৈতিক ভাবে ব্যবহার করতে সক্ষম হয়েছে। মন্দিরে বিগ্রহের প্রাণপ্রতিষ্ঠা অনুষ্ঠানটিকেও মূলত রাজনৈতিক কার্যক্রম করে তুলতে সফল হয়েছে বিজেপি। এখন প্রশ্ন, তাদের দলীয় কর্মসূচিতে পর্যবসিত অনুষ্ঠানে যোগ দিতে না চাওয়া কি ‘হিন্দুবিরোধী অবস্থান’?
আরএসএস-বিজেপি ও হিন্দুধর্মকে সমার্থক হিসাবে দেখাতে স্বভাবতই নাগপুরের আগ্রহ থাকবে। কিন্তু, স্মরণ করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন যে, নাগপুর যার বেসাতি করে, তার নাম হিন্দুত্ব— বিংশ শতকের প্রথমার্ধে মূলত মুসলমান-বিরোধিতার উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা একটি রাজনৈতিক অবস্থান। তার সঙ্গে হিন্দুধর্মের মিল রয়েছে বিলক্ষণ, কিন্তু আরএসএস-বিজেপির চালিকাশক্তিটি হিন্দুধর্ম নয়, হিন্দুত্ব। সেই রাজনৈতিক দর্শন চরিত্রগত ভাবে বিভেদকামী, ভারতের বহুত্ববাদী সংস্কৃতির সঙ্গে তার বিরোধ মূলগত। অতএব, যে কোনও উদারবাদী রাজনীতিই সেই সঙ্কীর্ণতার সঙ্গে নিজেদের স্পষ্ট তফাত বজায় রাখতে চাইবে। কংগ্রেস হিন্দু-বিরোধী কি না, সে প্রশ্ন ভিন্ন। কিন্তু আরএসএস-বিজেপি যে দেশের সব হিন্দুর প্রতিনিধিত্ব করে না, হিন্দুধর্মের বহুবিধ রূপের মধ্যে মাত্র একটি— তা-ও সবিশেষ ভাবে রাজনৈতিক, কৃত্রিম ও বিদ্বিষ্ট রূপের— বিজ্ঞাপন করে, তা নিয়ে সংশয় নেই। অযোধ্যার মন্দির উদ্বোধন সেই রাজনৈতিক কার্যক্রম। তার সঙ্গে ভারতাত্মার কোনও সম্পর্ক নেই, সামগ্রিক ভাবে হিন্দুধর্মেরও নয়।
মন্দির উদ্বোধনের অনুষ্ঠান থেকে দূরে থাকলেই অবশ্য উদারবাদী রাজনৈতিক দলগুলির কর্তব্য সমাধা হয় না। অযোধ্যার মন্দির যে প্রকৃত প্রস্তাবে ধর্মের প্রতীক নয়, বরং ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে সংখ্যালঘুর উপর সংখ্যাগরিষ্ঠের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার অভিজ্ঞান, এবং তা যে শেষ অবধি হিন্দুদের পক্ষেও সুসংবাদ নয়, এই কথাটি মনে করিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব তাদেরই নিতে হবে। অধ্যাপক অমর্ত্য সেন যথার্থই বলেছেন যে, এই সময়ে বড় দায়িত্ব হল সাম্প্রদায়িক বিভাজন যাতে মাথাচাড়া দিতে না পারে, তা নিশ্চিত করা। মন্দিরকে কেন্দ্র করে বিভাজনের রাজনীতির সুর চড়বেই। তাকে প্রতিহত করতে হবে। এত দিনে স্পষ্ট যে, ভারতীয় রাজনীতি থেকে ধর্মের মুদ্রাদোষ যাওয়ার নয়। কিন্তু, তার পরও যে ধর্ম এবং রাজনীতি দু’টি পৃথক সত্তা, এবং যারা সেই সীমারেখাটি মুছে দিতে চায়, তারা ধর্মকে শুধু ব্যবহার করে চলেছে নিজেদের রাজনীতির স্বার্থে, এ কথাটি বলে যেতে হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy