অগ্রসর, অগ্রসর, চল চল আগে চল, এই আমাদের ভেরীধ্বনি। অতীত অতীতে মিশিয়া গিয়াছে, ‘সম্মুখে মহা ভবিষ্যৎ’।— একশো বছর আগে বাংলা ১৩২৮ সালের দোলপূর্ণিমা তিথিতে প্রকাশিত প্রথম সংখ্যায় আনন্দবাজার পত্রিকা ‘আমাদের কথা’ নামক প্রস্তাবনায় এই কথাগুলো লিখেছিল। বিদেশি রাজশক্তির বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রামে শরিক হওয়ার ব্রত নিয়ে নবজাত সংবাদপত্রটি যে দৈনন্দিন অনুশীলনে অভিনিবেশ করেছিল, তা আজ শতাব্দীর ইতিহাস। সেই অতীত অতীতে মিশে গিয়েছে, পত্রিকার জীবনে দ্বিতীয় শতক শুরু হল আজ। সে দিনের নবীন লিপিকার আজ প্রবীণ হয়েছে, একশো বছরের অভিজ্ঞতায় সে শিখেছে যে অতীত অতীতে মিশে যায়, কিন্তু হারিয়ে যায় না, নদী যেমন সাগরে মিশলেও হারিয়ে যায় না, রোদ-মেঘ-বৃষ্টির নিরন্তর প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সেই জলরাশি থেকেই তার ভবিষ্যৎ জীবনীশক্তি তৈরি হয়। অতীত তো শুধু স্মৃতিচারণের সম্বল নয়, তার ঝুলিতে থাকে ভবিষ্যতের পাথেয়। আনন্দবাজার পত্রিকা সেই পাথেয়কে পূর্ণ মর্যাদা দিয়ে ভবিষ্যতের পথে চলেছে। দৈনিক সংবাদপত্রের কাছে প্রত্যেকটা দিনই নতুন, প্রতি দিন তার নতুন জন্ম। কিন্তু জন্মদিনের বিশেষত্ব অনস্বীকার্য। আজকের জন্মতিথিটি সব দিক থেকেই অনন্য। এমন দিনের নিজস্ব গৌরব নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু আত্মগৌরব শেষ বিচারে গৌণ, মুখ্য হল এই পুণ্যলগ্নে নিজের কর্তব্য যথাযথ নিষ্ঠায় ও সততায় পালন করে চলার শপথ। সমৃদ্ধ অতীতের পাদপীঠে দাঁড়িয়ে সমৃদ্ধতর ভবিষ্যৎ গড়ার অঙ্গীকার।
সেই অঙ্গীকার পালনের কাজটি সহজ নয়। বিশেষ করে, যে সামাজিক রাজনৈতিক অর্থনৈতিক পরিবেশে সংবাদপত্রকে আপন কর্তব্য সম্পাদন করতে হচ্ছে, তাকে কঠিন বা প্রতিকূল বললে নিতান্ত কম বলা হয়। এই পত্রিকার স্বাতন্ত্র্য তার উৎকর্ষের সাধনায়, তার স্বনির্ধারিত নীতিনিষ্ঠায়, বৃহতের প্রতি তার আপসহীন মর্যাদাবোধে। দেশের, বিশেষত এ রাজ্যের ঝিমিয়ে-থাকা অর্থনীতি, ছোট মাপের রাজনীতি এবং মধ্যমেধার বশীভূত সমাজ— কোনওটাই তাকে এই লক্ষ্যগুলো পূরণ করার পথে চলতে সাহায্য করে না, বরং প্রতি পদে বাধা দেয়। এই সমস্যা নতুন নয়, অনেক কাল ধরে সে এমন পরিবেশেই কাজ করে আসছে। কিন্তু দিনে দিনে এই প্রতিকূলতা বেড়েই চলেছে। সবচেয়ে বড় সমস্যা হল, উৎকর্ষের সাধনায় সে বাইরে থেকে যথেষ্ট তাগিদ পায় না, কারণ সমাজে উৎকর্ষের কদর নেই, দাবিও নেই। সেই তাগিদ তাকে নিজের ভিতর থেকেই খুঁজে নিতে হয়েছে, নিজেকেই নিজের প্রতিদ্বন্দ্বীর আসনে বসিয়ে আত্মোন্নতির চেষ্টা জারি রাখতে হয়েছে।
এই সাধনায় তার বড় সহায় নিশ্চয়ই পাঠকসমাজ, যাঁরা একই সঙ্গে অনুরাগী এবং সমালোচক হিসাবে সর্বদা পত্রিকার সঙ্গে থেকেছেন, তাকে আপন ঘাটতির ব্যাপারে সজাগ রেখেছেন। এই সহৃদয় এবং আপসহীন অভিভাবকত্বই ভবিষ্যতেও সংবাদপত্রের পরম সহায় থাকবে, এমন ভরসা না করার কিছুমাত্র কারণ নেই। কিন্তু অভিভাবকের মানসিক রূপান্তরের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সংবাদপত্রকেও নিরন্তর নিজেকে পরিমার্জিত করতে হবে। সমাজের মানসিকতা যে ভাবে বদলাচ্ছে এবং প্রযুক্তির বিপ্লব যে ভাবে সেই পরিবর্তনকে ক্রমশই আরও দ্রুতগামী করে তুলছে, তার ফলে সংবাদপত্রের সঙ্গে তার পাঠকদের সম্পর্কে আরও বেশি করে যুক্ত হচ্ছে কথোপকথনের ধারাটি। আনন্দবাজার পত্রিকা এই মাত্রাটির গুরুত্ব সম্পর্কে সজাগ। অতীতে সে আপন ঐতিহ্যে অবিচল থেকেই নতুন যুগের প্রয়োজনে নিজেকে পরিমার্জিত করেছে, ভবিষ্যতেও সেই প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে। এই কথা মনে রেখেই শতবর্ষ পূর্তির ক্ষণে তার প্রার্থনা: অগ্রসর, অগ্রসর।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy