দুর্ভাগ্য ভারতের, যেখানে দেশের একটি বড় অংশের মানুষের নিকট সরকারের যে কোনও পদক্ষেপই সন্দেহজনক ঠেকে। সম্প্রতি ঘোষিত ‘ন্যাশনাল মনিটাইজ়েশন পাইপলাইন’ সম্বন্ধে রাহুল গাঁধী যে সংশয়টি প্রকাশ করিলেন— ইহা সরকার-ঘনিষ্ঠ কতিপয় শিল্পগোষ্ঠীকে সস্তায় জাতীয় সম্পদ পাওয়াইয়া দিবার ব্যবস্থা— তাহা শুধুই রাহুলের, বলিলে অনৃতভাষণ হইবে। বিগত সাত বৎসরে এই সরকারের বহু সিদ্ধান্তই শেষ অবধি জনস্বার্থ অপেক্ষা সাঙাতস্বার্থ রক্ষা করিয়াছে বেশি, এমন অভিযোগ আক্ষরিক অর্থেই সর্বভারতীয়। কাজেই সতর্ক থাকা প্রয়োজন; সাঙাততন্ত্রের চক্রটি ভাঙিবার কাজ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই সম্ভব। কিন্তু, সেই সতর্কতা যদি যথাযথ পদক্ষেপগুলিতেও বাধার সৃষ্টি করিতে চাহে, তাহা দুর্ভাগ্যজনক হইবে। অর্থমন্ত্রী যে মনিটাইজ়েশন পাইপলাইন-এর নীতি ঘোষণা করিয়াছেন, অর্থনীতির বিচারে তাহা গুরুত্বপূর্ণ, এবং জরুরি। ভারতে রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের হাতে বিপুল পরিকাঠামো-সম্পদ পড়িয়া আছে। টেলিগ্রাফের খুঁটি হইতে ভূগর্ভস্থ কেব্ল, বিশালায়তন বাড়ি হইতে গ্যাসলাইন, সৌরবিদ্যুৎ পরিকাঠামো হইতে রেললাইন— এমন বহুবিধ পরিকাঠামো-সম্পদ হয় অব্যবহৃত অবস্থায় পড়িয়া আছে, নয়তো তাহার নিতান্তই অকুশলী ব্যবহার হইতেছে। সেই সম্পদগুলিতে যে টাকা আটকাইয়া আছে, অব্যবহৃত অবস্থায় পড়িয়া আছে, তাহাকে যদি সেই অকুশলতার বাঁধন খুলিয়া বাহির করিয়া আনা যায়, দেশের উন্নয়নের কাজে ব্যবহার করা যায়, তবে তাহাকে স্বাগত না জানাইবার কিছুমাত্র কারণ নাই।
বরং, একটি অন্য প্রশ্নে আপত্তি তোলা প্রয়োজন। মনিটাইজ়েশন পাইপলাইন ঘোষণার সময় অর্থমন্ত্রী অতি সতর্ক ভঙ্গিতে বারংবার স্মরণ করাইয়া দিয়াছেন যে, তাঁহারা দেশের সম্পদ বিক্রয় করিতেছেন না; একটি নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য তাহাকে ব্যবহারের অধিকার দিতেছেন মাত্র। বিলগ্নিকরণের প্রশ্নে তাঁহাদের এই অস্বস্তি বারে বারেই প্রকট হইতেছে। সম্প্রতি বিমা সংস্থার বেসরকারিকরণের প্রসঙ্গটিকেও তাঁহারা বহু ঘুরপথে রাখিয়া-ঢাকিয়া পেশ করিলেন। এই অস্বস্তির একটি কারণ সম্ভবত অর্থনৈতিক সংস্কারে নাগপুরের অনীহা। কিন্তু, প্রকৃত সংস্কার চাহিলে প্রধানমন্ত্রী-অর্থমন্ত্রীকে সেই প্রক্রিয়ায় বিশ্বাস করিতে হইবে। মানিতে হইবে যে, দার্জিলিঙের পাহাড়ি পথে টয় ট্রেন চালানো কোনও মতেই সরকারের কাজ হইতে পারে না! এমনকি, সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগও উপযুক্ত পথ নহে। ভারতে গত দেড় দশকে এই গোত্রের উদ্যোগের ফল নিরাশাজনক। সেই ব্যর্থতার বড় কারণ হইল, যে কোনও অর্থনৈতিক প্রক্রিয়ায় যদি সরকারের সিদ্ধান্ত লইবার অধিকার থাকে, তবে সিদ্ধান্তগুলি শেষ অবধি অর্থনীতির যুক্তির পরিবর্তে রাজনীতির যুক্তি দ্বারা নির্ধারিত হয়। নির্মাণের খরচ পুনরুদ্ধারের পর শেষ অবধি হাইওয়ে প্রকল্প যখন লগ্নিকারীর পক্ষে লাভজনক হইয়া উঠিতে থাকে, তখনই সরকার তাহাকে নিঃশুল্ক করিবার সিদ্ধান্ত লইলে লগ্নিকারীদের পক্ষে পরবর্তী কালে সরকারকে বিশ্বাস করা কঠিন হয় বইকি।
বিলগ্নিকরণই হউক বা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ব্যবহারের অধিকার প্রদান, যে পথেই হাঁটা হউক না কেন, রাষ্ট্রায়ত্ত পরিকাঠামো ক্ষেত্রে আটকাইয়া থাকা টাকার মুক্তি যেমন জরুরি, তেমনই গুরুত্বপূর্ণ এই সম্পদগুলির কুশলী ব্যবহার। সেই কুশলতা নির্দিষ্ট করিবার অন্যতম শর্ত হইল অর্থব্যবস্থায় একচেটিয়া আধিপত্য তৈরি হইতে না দেওয়া। বিমানবন্দর, রেললাইন, খনিজ সম্পদ— এমন অনেক ক্ষেত্রেই মনিটাইজ়েশন হইতেছে, যাহাতে কোনও সংস্থার একচেটিয়া আধিপত্য গড়িয়া উঠিলে দেশের মানুষের স্বার্থহানি হইবে। এই ধরনের আধিপত্য যাহাতে না গড়িয়া উঠে, সরকারকে তাহা নিশ্চিত করিতে হইবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy