নবনির্বাচিত কলিকাতা পুরসভায় সম্পূর্ণ স্থিতাবস্থা বজায় থাকিল, এমন কথা বলা চলে না। মেয়র পারিষদ মণ্ডলীতে কিছু নূতন মুখ দেখা দিয়াছে, অধিকাংশ বরো কমিটিতে প্রধানের পদে মেয়েদের প্রতিষ্ঠাও যথার্থ প্রগতিশীল চিন্তার পরিচায়ক। কিন্তু পুরসভার নেতৃত্ব যথা পূর্বম্ তথা পরম্। মেয়র, ডেপুটি মেয়র এবং চেয়ারপার্সন-এর ন্যায় পদগুলিতে বিদায়ী নায়কনায়িকারাই পুনরধিষ্ঠিত। সকলই যাঁহার ইচ্ছা, সেই মুখ্যমন্ত্রীর ব্যাখ্যা: পুরসভার কাজে অভিজ্ঞতা মূল্যবান, ধারাবাহিকতার প্রয়োজন। এই ব্যাখ্যা অযৌক্তিক নহে। তবে কিনা, এক দশক আগে পরিবর্তন-এর জয়ধ্বজা উড়াইয়া যাঁহার ক্ষমতায় আরোহণ, তাঁহার নিকট সামান্য সাহসী পরীক্ষানিরীক্ষা দাবি করিলে কলিকাতাবাসী খুব বড় অন্যায় করিবেন কি? বিশেষত, মেয়র যখন মন্ত্রীও বটেন। বস্তুত, একই সঙ্গে মন্ত্রী এবং মেয়রের দায়িত্ব বহনের যে রীতিটি তৈয়ারি হইয়াছে, তাহাতে দুই পদেরই অমর্যাদা হয়, ক্ষতি হয় দুই কাজেরই। আর, তর্কের খাতিরে মেয়রকে অতিমানব বলিয়া ধরিয়া লইলেও সেই পুরাতন প্রশ্নটি থাকিয়াই যাইবে: রাজকন্যা কি কম পড়িয়াছে?
পুরাতনকে সরাইয়া রাখিয়া আপাতত নয়া প্রশ্নে মন দেওয়া যাইতে পারে। নূতন এবং অংশত নবীন পুরসভা কি তাহার কাজের ধারায় পরিবর্তন আনিতে পারিবে? আশ্বাস ও প্রতিশ্রুতির অভাব নাই। মেয়র পদে পুনরভিষেকের পূর্বেই ফিরহাদ হাকিম কেবল নাগরিকদের ‘পাশে থাকিবার’ সঙ্কল্প ঘোষণা করেন নাই, পুরসভার বার্ষিক মূল্যায়নের ব্যবস্থা চালু করিবার কথা বলিয়াছেন। তাঁহার নেত্রীর কণ্ঠেও শোনা গিয়াছে পুরসভার কাজের নিয়মিত নজরদারির চেতাবনি। ক্ষমতাসীন শিবির নির্বাচনে জয়ী হইবার পরে এমন সুভাষিতাবলি অকাতরে বিতরণ করিয়াই থাকে, ইহাতে অন্তত কিছুমাত্র নূতনত্ব নাই। কাজের কাজ কতটুকু হইবে, তাহাই প্রকৃত বিচার্য। গত দশ বছরের ইতিহাস সেই বিষয়ে যথেষ্ট ভরসা দিতে পারে কি? এই সময়পর্বে কলিকাতা শহরের মুখশ্রীতে সংস্কার ঘটিয়াছে, মহানগরীর অনেক এলাকা, বিশেষত নদীতীর বা ময়দানের কিছু অঞ্চল দেখিতে অতীতের তুলনায় সুদর্শন হইয়াছে, এই সত্য অবশ্যই মানিতে হইবে। বিভিন্ন এলাকায় জঞ্জাল অপসারণের পরিকাঠামো উন্নত হইয়াছে, স্থানীয় কিছু উদ্যানের হাল ফিরিয়াছে। এই সকলই নিশ্চয় ইতিবাচক।
কিন্তু তাহার পাশাপাশি বহু বিষয়ে শহরের সমস্যা এখনও বিপুল এবং তাহার সমাধানে পুরসভার যথার্থ উদ্যোগ অনুপস্থিত। গত কয়েক বৎসর ধরিয়া এই অনুপস্থিতির যথেষ্ট প্রমাণ দেখা গিয়াছে। মহানগরের নিকাশিব্যবস্থার সংস্কার দূরস্থান, নর্দমাগুলি পরিষ্কার করিবার দৈনন্দিন কাজেও প্রভূত ফাঁকি, যাহা অল্প বৃষ্টিতেই জল জমিবার এবং দীর্ঘ সময়েও জল না সরিবার একটি বড় কারণ। বহু ভঙ্গুর বাড়ি ‘বিপজ্জনক’ তকমা বুকে লইয়া প্রতিনিয়ত বিপর্যয়ের দিন গনিতেছে, মাঝে মাঝেই ইতস্তত ভাঙিয়া পড়িতেছে, পুরসভা নিশ্চল। অন্য দিকে, সংক্রামক ব্যাধি নিবারণে পুরসভা বৎসরের পর বৎসর নানা আড়ম্বর করে, কাজ তাহার সিকিভাগও করে না। এমন দৃষ্টান্ত আরও অনেক দেওয়া যাইতে পারে। বস্তুত, কলিকাতার আংশিক মুখশ্রী ফিরিলেও সর্বাঙ্গের কুশ্রী ও ব্যাধিগ্রস্ত দুর্দশা ঘুচে নাই। ইহার পিছনে এক দিকে অপদার্থতা ও ঔদাসীন্য, অন্য দিকে দুর্নীতি ও দলতন্ত্রের যৌথ ক্রিয়া। পুরসভায় দুর্নীতির অভিযোগ অতি প্রাচীন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জমানাতেও সেই ঐতিহ্য সমানে চলিতেছে। স্থানীয় ক্ষমতার কেন্দ্রগুলিকে তোষণের রাজনীতি এবং তাহার সহিত দলতন্ত্রের গভীর প্রণয় বাড়িয়াছে বই কমে নাই। এই মৌলিক ব্যাধির নিরাময় না হইলে পুরশ্রী বিবর্ধনের বাণীটি লোকদেখানো সাজসজ্জাতেই সীমিত থাকিবে, এই ভবিষ্যদ্বাণী করিতে অলৌকিক কোনও বিদ্যার প্রয়োজন নাই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy