মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁহার দলের সর্বময়ী কর্ত্রী, এই সংবাদ ভূভারতে কাহারও অজানা নহে। সংবাদের সত্যতা সম্পর্কেও কাহারও সংশয় নাই। দলের সমস্ত সদস্য, সর্বস্তরের নেতানেত্রী এবং সর্বোপরি সর্বাধিনায়িকা তিলমাত্র সংশয়ের অবকাশ রাখেন নাই। তাঁহাদের কথায় ও কাজে এই সত্য বরাবর সহস্রধারে উৎসারিত হইয়া আসিতেছে। তাহা সত্ত্বেও দলীয় সাংসদদের সভায় তাঁহাকে যদি নিজমুখে বলিতে হয় যে দলে তিনিই শেষ কথা, ঈষৎ বিস্ময় জাগে বইকি। সংশয়ী নাগরিক এমনকি এই প্রশ্নেও তাড়িত হইতে পারেন যে, তবে কি অন্দরের অন্তরে কিছু কিছু বিবাদী স্বর বাজিতেছে? নবীন এবং প্রবীণ, ঘরের এবং বাহিরের, কাছের এবং দূরের বিবিধ মহল, শিবির বা গোষ্ঠীর মধ্যে নানা সুর উঠিতেছে? অবিসংবাদিত নেত্রীত্বের চলার পথে বিসংবাদের কাঁটার— অথবা চোরকাঁটার— সন্ধান মিলিতেছে? সম্প্রতি একাধিক উপলক্ষে এবং একাধিক স্তরে দলের কিছু কিছু নেতা ও মন্ত্রীর আচরণে এবং উচ্চারণে যে অ-শান্তি প্রকট হইয়াছে, তাহা কি গভীরতর বিসংবাদের উপসর্গ? এবং সেই কারণেই নেত্রীকে সরাসরি আপন কর্ত্রীত্ব ঘোষণা করিয়া বলিতে হইতেছে: সো(অ)হম্। আমিই সে। মতান্তরে, সে-ই আমি।
এমন প্রশ্ন নেত্রীর পক্ষে অস্বস্তিকর হইলেও তিনি বা তাঁহার অনুগামীরা হয়তো তাহাকে সম্পূর্ণত দমন করিতে পারিবেন না; সংশয় অতি বিষম বস্তু। কিন্তু শেষ বিচারে তাহা গৌণ প্রশ্ন। অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ এই জল্পনার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য, যাহা বিশেষ উপলক্ষকে অতিক্রম করিয়া বৃহত্তর ও গভীরতর সত্যের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সেটি গণতন্ত্রের সত্য। গণতান্ত্রিক নেতৃত্বের সত্য। ভাবের ঘরে চুরি করিয়া লাভ নাই— গণতন্ত্রের সহিত নেতৃত্বের সম্পর্ক স্বভাবত মসৃণ নহে, বরং সেই সম্পর্কে টানাপড়েনই স্বাভাবিক। রসিকজনে বলিতে পারেন, সম্পর্কটি দাম্পত্যের অনুরূপ, যে সম্পর্ক নিরন্তর এবং অনিবার্য টানাপড়েনের মধ্য দিয়াই অগ্রবর্তী হয়, জোরদারও হয়। সেই উপমা সার্থক হউক বা না হউক, যথার্থ গণতন্ত্রে নেতা বা নেত্রীকে প্রতিনিয়ত কঠিন ভারসাম্য রক্ষা করিয়া চলিতে হয়। গণতান্ত্রিকতা তাঁহার নিকট দাবি করে: সকলের কথা শুনিতে হইবে, কেবল কান দিয়া শুনিলে চলিবে না, মন দিয়া শুনিতে হইবে; আবার, নেতৃত্বের দাবি: প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত তিনিই লইবেন এবং তাহার দায়িত্ব স্বীকার করিবেন। দুইয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান কঠিন কাজ, কত কঠিন তাহা অযোধ্যার রাজা রামচন্দ্র হাড়ে হাড়ে বুঝিয়াছিলেন।
অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, নেতা বা নেত্রী সামঞ্জস্যের দাবিকে হেলায় উড়াইয়া দিয়া, ভারসাম্য রক্ষার কিছুমাত্র চেষ্টা না করিয়া ‘সবার উপরে আমিই সত্য’ ঘোষণা করিয়া সমস্ত ক্ষমতা আপনার হাতে কেন্দ্রীভূত করিতে তৎপর হন। জনসাধারণ দূরস্থান, আপন সহকর্মী বা উপদেষ্টাদের পরামর্শ, বিশেষত ভিন্নমত শুনিবার বিষয়ে তাঁহাদের প্রবল বিরাগ, যে বিরাগ অনায়াসে অসহিষ্ণুতায় রূপান্তরিত হয়। সহকর্মী বা অনুগামীদের মধ্যে মতানৈক্য দেখা দিলে এই অসহিষ্ণুতায় বাড়তি একটি মাত্রা সংযোজিত হইতে পারে, তাহার নাম সংশয়। এই সংশয় যে, আপন কর্তৃত্বের মহিমা খর্ব হইতেছে, সঙ্গীরা কথা শুনিতেছে না, নিজেদের মধ্যে কলহে লিপ্ত হইতেছে, এমনকি পরোক্ষে নেতৃত্বের মর্যাদাকেও অগ্রাহ্য করিতেছে। এমন পরিস্থিতিতেই উচ্চাসন হইতে কঠোর নির্দেশ নামিয়া আসে। সুতরাং নির্দেশের রকম শুনিয়া পরিস্থিতি সম্পর্কেও কিছু ধারণা জন্মাইতে পারে। পশ্চিমবঙ্গের শাসক দলের অন্দরমহলে প্রতিস্পর্ধী শক্তির উদয় হইতেছে, তাহার ফলে দলনেত্রী স্ব-ক্ষমতা লইয়া সংশয়ী হইতেছেন— এমন জল্পনা কষ্টকল্পনার নামান্তর। কিন্তু তাহার পরেও, বস্তুত সেই কারণেই, সংশয় থাকিয়া যায়— সবার উপরে আপন স্থান দাবি করিবার এই নূতন আত্ম-নির্ঘোষের প্রয়োজন পড়িতেছে কেন?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy