Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
journalist

সংবাদের শক্তি

প্রশাসনের স্বৈরাচারের সহিত সাংবাদিকদের প্রতি নিষ্ঠুরতা সমানুপাতিক হারে বাড়িতেছে।

সাংবাদিক বুদ্ধিনাথ ঝায়ের দগ্ধ দেহ।

সাংবাদিক বুদ্ধিনাথ ঝায়ের দগ্ধ দেহ। ফাইল চিত্র।

শেষ আপডেট: ১৯ নভেম্বর ২০২১ ০৫:০৩
Share: Save:

সা‌ংবাদিক বুদ্ধিনাথ ঝায়ের দগ্ধ দেহ মিলিল বিহারের মধুবনী জেলায়। বাইশ বৎসরের এই তরুণের হত্যায় এই বৎসর নিহত ভারতীয় সাংবাদিকের সংখ্যা দাঁড়াইল চার। গত পাঁচ বৎসরে অন্তত তেরো জন সাংবাদিক নিহত হইয়াছেন। তাঁহাদের অপরাধ, তাঁহারা আপন কর্তব্য করিয়াছিলেন। অন্ধ্রপ্রদেশের চেন্নাকেশাভালু, বিহারের মনীশ কুমার সিংহ এবং বুদ্ধিনাথ ঝা, উত্তরপ্রদেশের সুলভ শ্রীবাস্তব— যে চার সাংবাদিক এই বৎসর প্রাণ হারাইয়াছেন, তাঁহারা সকলেই আপন এলাকায় অপরাধচক্রের কীর্তি, অথবা উচ্চপদস্থ আধিকারিকদের দুর্নীতির বিষয় সংবাদে প্রকাশ করিতেছিলেন। তাঁহাদের হত্যা করিয়া ক্ষমতাসীন, রাজনৈতিক প্রশ্রয়প্রাপ্ত দুষ্কৃতীরা সকল সাংবাদিকের বিরুদ্ধে এক উদ্ধত সতর্কবার্তা প্রেরণ করিতেছে। গত কয়েক বৎসরে দেখা গিয়াছে, সাংবাদিকদের হত্যা অথবা প্রহার-নির্যাতনে অভিযুক্তদের বিচার ও শাস্তি দূরের কথা, তাহারা গ্রেফতারও হয় না। গ্রেফতার হইতেছেন বরং সাংবাদিকরাই। ত্রিপুরায় সাম্প্রদায়িক অশান্তির সংবাদ করিতে গিয়াছিলেন দিল্লির দুই তরুণী, সংবাদ প্রেরণ করিবার পূর্বেই তাঁহারা গ্রেফতার হইয়াছেন। হাথরস-কাণ্ডের খবর করিতে যাইবার পথে সিদ্দিক কাপ্পান গ্রেফতার হইয়াছিলেন— তিনি এক বৎসরের উপর কারাবাস করিতেছেন। বস্তারের সাংবাদিক সন্তোষ যাদব আদিবাসীদের উপর পুলিশের নির্যাতনের খবর করিবার জন্য সতেরো মাস কারাবাস করিয়া, অবশেষে জামিনে মুক্ত হইয়াছেন। সম্পাদক তথা সাংবাদিকের পুলিশি হয়রানি, ট্রোলবাহিনীর হুমকি, রাষ্ট্রদ্রোহী বা সন্ত্রাসবাদী অভিযোগে তাহার বিরুদ্ধে মামলা, এই সকলই যেন ক্রমশ ‘স্বাভাবিক’ হইয়া উঠিয়াছে। প্রশাসনের স্বৈরাচারের সহিত সাংবাদিকদের প্রতি নিষ্ঠুরতা সমানুপাতিক হারে বাড়িতেছে।

কেন সাংবাদিকের প্রতি সরকারের এই বৈরিতা, তাহা প্রায় দুই শত বৎসর পূর্বে স্পষ্ট করিয়াছিলেন রামমোহন রায়। ১৮২৩ সালে বিদেশি শাসকের ‘প্রেস অর্ডিন্যান্স’-এর প্রতিবাদ করিয়া তিনি লিখিয়াছিলেন, স্বৈরাচারী শাসক স্বাভাবিক ভাবেই বাক্‌স্বাধীনতা দমাইতে চায়, কারণ তাহাদের অত্যাচার ও নিপীড়ন জনসমক্ষে প্রকাশিত হইলে চূড়ান্ত নিন্দিত হইবে। অপর পক্ষে, যাঁহারা সুপ্রশাসক, তাঁহারা প্রশাসনে বিবিধ ভ্রান্তির প্রতি সজাগ থাকিতে আগ্রহী, অতএব সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার সমর্থক। রামমোহনের এই কথাগুলি বুঝাইয়া দেয়, স্বাধীনতা সংগ্রামের সূচনার বহু পূর্বেই সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার যুদ্ধ শুরু করিয়াছিলেন ভারতীয়রা। একশত বৎসর পরে, ১৯২২ সালে, মহাত্মা গাঁধী ইয়ং ইন্ডিয়া পত্রিকায় লিখিয়াছেন, “বাক্‌স্বাধীনতার অর্থ, বাক্য যখন আঘাত করিতেছে তখনও তাহাকে বাধাদান হইতে বিরত থাকা। সংবাদের স্বাধীনতার প্রতি যথার্থ শ্রদ্ধার পরিচয় তখনই মিলিবে, যখন সংবাদমাধ্যম কোনও বিষয়ে অত্যন্ত কঠোর ভাষায় মন্তব্য করিতে পারে, এমনকি তাহার ভ্রান্ত প্রতিফলনও করিতে পারে।” গাঁধীর মতে, ভ্রান্তি অথবা হিংসার বিরুদ্ধে সুরক্ষার উপায় প্রশাসনিক নির্দেশে সংবাদমাধ্যমের মুখ বন্ধ করা নহে— যে বাস্তবিক অপরাধী, তাহার শাস্তিবিধান।

এই কথাগুলিকে ইতিহাসের পাতায় বন্দি করিয়া রাখিলেই বর্তমান ভারতের নেতা-মন্ত্রীরা স্বস্তি পাইতেন। কিন্তু রামমোহন রায় ও গাঁধীর কথাগুলি প্রতিটি ভারতীয়ের উত্তরাধিকার। গত পঁচাত্তর বৎসরের অভিজ্ঞতায় ভারতবাসী বরং বুঝিয়াছে, বাক্‌স্বাধীনতা কেবল অধিকার বা আদর্শমাত্র নহে, তাহার সহিত সামাজিক ন্যায় ও মানব উন্নয়নের সাক্ষাৎ সংযোগ রহিয়াছে। আগামী বৎসর ভারতের স্বাধীনতার ৭৫ পূর্তি। তাহা অসার আড়ম্বর থাকিয়া যাইবে, যদি সাংবাদিকের স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা ক্রমাগত খর্ব হইতে থাকে।

অন্য বিষয়গুলি:

journalist Bihar
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy