দুইটি গোটা বৎসর কাটিবার পর আবারও বসিল আন্তর্জাতিক কলিকাতা পুস্তক মেলার আসর। বইমেলা বস্তুটি যে বাঙালি জীবনের কতখানি অধিকার করিয়া রহিয়াছে— কেবল কলিকাতা নহে, পশ্চিমবঙ্গে— তাহা বুঝা গেল। মেলা আয়োজিত না হইলে বাঙালি ক্যালেন্ডারে কয়েকটি দিন যেন ফাঁকি পড়িয়া যায়— পুরবাসীর উৎসাহ-উদ্দীপনা, সময় খুঁজিয়া দূরদূরান্তের জেলা হইতে বইপ্রেমীদের রাজধানীতে পৌঁছাইয়া যাওয়া, অন্তত একটি দিন প্রাঙ্গণে উপস্থিত হইবার প্রাণান্ত পরিকল্পনা বলিয়া দেয় সেই কথা। নিশ্চিত ভাবেই এখন বইমেলা পনেরো কিংবা ষোলো নম্বর পার্বণের স্থানটি লইয়াছে। এখন, ইহাতে কত আনা পুস্তকপ্রেম আর কত আনা মেলার প্রতি আগ্রহ, সেই প্রশ্ন উঠিতেই পারে, উঠিতেছেও। ছোট প্রকাশকেরা মাছি তাড়াইলেও ফুচকা-রোল কী ভাবে নিমেষের ভিতর উড়িয়া যায়, নজরে পড়িতেছে। এমনকি, উৎকৃষ্ট সাহিত্যসাধনাকে সকরুণ ভাবে কাঁদাইয়া জোক লাইফস্টাইল বিপণন ইত্যাকার লঘু বিষয়ের বইগুলিই যে মেলাপিয়াসির ব্যাগে ঠাঁই পায়, তাহাও প্রতি বৎসর প্রকটতর হইতেছে। তথাপি মেলা শব্দটির আদিতে যে হেতু ‘মিল্’ ধাতু, সেই উদ্দেশ্য সাধিত হইতে বাকি নাই। পাঠকের লঘুগুরু বিচার, কিংবা বই এবং ফুচকার মধ্যে গুণগত তুলনার পাশাপাশি তাই স্বীকার করিতেই হয় যে, বইমেলার গুরুত্ব সত্যই বিপুল। অতিমারি যে স্বাভাবিক জীবনচর্যা ভুলাইয়া দিয়াছিল, সেই আমেজ শহরবাসী ফিরিয়া পাইল অনেকাংশে। উপরন্তু এই বৎসর বইমেলার থিম কান্ট্রি বাংলাদেশ: সে দেশের জন্মের পঞ্চাশ বৎসর পূর্তির সঙ্গে এই থিম আয়োজনের অবশ্যই একটি যোগ আছে। দুই বাংলার কিছু বাঙালি অন্তত এই উপলক্ষে মিলিত হইতে পারিলেন— কম কথা নহে। সাংস্কৃতিক জীবনের এই স্বাভাবিক দেওয়া-নেওয়ার অনুভূতিগুলিও আর এক বার তৈয়ারি হইতে পারিল কলিকাতা পুস্তক মেলার সৌজন্যে।
উৎসবের আনন্দ অবশ্য জরুরি কিছু প্রশ্ন চাপা দিতে পারে না। পুস্তক মেলার যাহা মুখ্য উদ্দেশ্য, অর্থাৎ কলিকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গের প্রকাশকদের ব্যবসা বর্ধনের সুযোগ— তাহা যথাযথ ভাবে সাধিত হইতেছে কি? না কি লাভের অধিকাংশই অ-বাংলা বইয়ের প্রকাশক এবং বাহিরের প্রদেশের ব্যবসায়িকরা লইয়া যাইতেছেন? যদি তাহাই হয়, তবে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পক্ষে এত বড় একখানি উদ্যোগে অংশগ্রহণ যথেষ্ট যুক্তিপূর্ণ কি? বইমেলা নিশ্চয়ই জরুরি, এই যুগে গ্রন্থকে কেন্দ্র করিয়া বহু পাঠকের এক জায়গায় হওয়া কত বড় কথা, তাহার গুরুত্ব ব্যাখ্যা নিষ্প্রয়োজন। কিন্তু, পুস্তক মেলার আর্থিক সহায়তার ভার সরকার কেন গ্রহণ করিবে, সে বিষয়টি স্পষ্ট নহে। নিন্দক বলিতে পারেন, ইহার ফলে স্বাধীন মেলার উপরে রাজনৈতিক আধিপত্যের করাল ছায়াটিও নিয়মিত গাঢ় হইয়া উঠে। মুশকিল হইল, অভিজ্ঞতা এমনও বলিতেছে যে, সরকারের ছত্রছায়ার বাহিরে এই বঙ্গে পুস্তকব্যবসায়ীরা নিজস্ব দায়িত্বে কোনও উদ্যোগ গড়িবেন, এবং পারস্পরিক খেয়োখেয়ির ঝঞ্ঝা-বিদ্যুৎ তাহাকে অকালহত করিবে না, তেমন ভরসাও না করাই ভাল। বাংলা সাহিত্যজগতের বিখ্যাত খেয়োখেয়ি প্রবণতাটি এই বৎসরেও পূর্ণত দৃশ্যমান— লিটল ম্যাগাজ়িন প্যাভিলিয়নের ত্রিধাবিভক্তির মধ্যে। অপ্রিয় প্রশ্নগুলির, অতএব, এক কথায় কোনও উত্তর নাই। মেলার উৎসবের আনাচেকানাচে তাহার সন্ধান চলিবে, আশা রহিল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy