উলুখাগড়ার প্রাণহানির সম্ভাবনা সব যুদ্ধেই প্রবল, বুশসাহেব যাহাকে মুচকি হাসিয়া বলিতেন ‘কোল্যাটারাল ড্যামেজ’। রুশ-ইউক্রেন সম্মুখসমরে ভারতীয় অর্থব্যবস্থা মারা পড়িতে পারে, এমন আশঙ্কা প্রকট হইতেছে। যুদ্ধের প্রত্যক্ষ প্রভাব ভারতের উপর সামান্যই পড়িবে, কারণ ভারতের মোট বৈদেশিক বাণিজ্যের এক শতাংশেরও কম ঘটে রাশিয়ার সহিত। সেই বাণিজ্যেরও একটি বড় অংশ সামরিক সরঞ্জাম সংক্রান্ত। ইউক্রেনের সহিত ব্যবসায়িক সংযোগের মাত্রা আরও কম। অতএব, ভারত যুদ্ধক্ষেত্রে সরাসরি আহত হইবে, সেই সম্ভাবনা নাই।
ভারতীয় অর্থব্যবস্থার গায়ে যাহা লাগিবে, তাহা পরোক্ষ প্রভাব। প্রথম আশঙ্কাটি পেট্রোলিয়ামের দাম সংক্রান্ত। রাশিয়া বর্তমানে বিশ্বের বৃহত্তম পেট্রোপণ্য রফতানিকারক দেশ— বৈশ্বিক রফতানির সাত শতাংশের অধিক রাশিয়া হইতে হয়। আমেরিকা সম্প্রতি রাশিয়ার পেট্রোপণ্য আমদানির উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করিয়াছে। ইউরোপের বেশির ভাগ দেশ এখনও তাহা করে নাই বটে, কিন্তু প্রত্যেকটি দেশই সতর্ক হইয়া পা ফেলিতেছে। ফলে, অবশিষ্ট তেলের বাজারে একটি কৃত্রিম উচ্চ চাহিদা তৈরি হইয়াছে। তাহারও অধিক হইয়াছে ভবিষ্যতে প্রবলতর মূল্যবৃদ্ধির আশঙ্কা। এখন এক ব্যারেল তেলের দাম ১৪০ ডলারের কাছাকাছি। অনুমান, যুদ্ধ পরিস্থিতির সমাধান না হইলে বৎসরের শেষে তাহা ১৮৫-১৯০ ডলারে পৌঁছাইতে পারে। এই আশঙ্কাই বাজারে তেলের দাম বাড়াইয়া দিয়াছে। তাহার প্রভাব পড়িতেছে ভারতীয় অর্থনীতিতে। পাশাপাশি, যুদ্ধ আরম্ভ হইবার পর ডলারের সাপেক্ষে টাকার দামের প্রায় অবাধ পতন ঘটিয়াছে। ফলে, টাকার অঙ্কে পেট্রোলিয়াম আমদানির খরচ আরও বাড়িয়াছে। তাহার উপর, আন্তর্জাতিক বাজারে অন্যান্য পণ্যমূল্য বৃদ্ধি পাইতেছে অস্বাভাবিক হারে। গত বৎসরের মূল্যবৃদ্ধির পর যখন এই দামে স্থিতি আসিবার সম্ভাবনা তৈরি হইতেছিল, যুদ্ধ আসিয়া তাহা বিনষ্ট করিল। এই মূল্যবৃদ্ধির প্রভাবও ভারতের বাজারে পড়িতেছে। ইতিমধ্যে দেখা যাইতেছে, দেশের বাজারে উৎপাদক সংস্থাগুলি পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির মাধ্যমে অন্তর্বর্তী পণ্যের মূল্যস্ফীতির বোঝাটি অন্তিম গ্রাহকের ঘাড়েই চাপাইতেছে। ফল, সামগ্রিক মূল্যবৃদ্ধি। অর্থাৎ, যুদ্ধের আঁচ ভারতে পৌঁছাইবে প্রধানত মূল্যস্ফীতির পথেই। তাহা ভিন্ন, আন্তর্জাতিক লেনদেনের বাজারের কিছু অনিশ্চয়তাও ভারতের উপর প্রতিকূল প্রভাব ফেলিতে পারে।
ভারতীয় অর্থব্যবস্থা এখনও মূলত অভ্যন্তরীণ চাহিদা-চালিত। ফলে, দেশীয় অর্থনীতির স্বাস্থ্যটি যদি ভাল থাকিত, তাহা হইলে এই ধাক্কা সামলাইয়া লইবার সাধ্য ভারতের থাকিত। কিন্তু গত সাত-আট বৎসরের অপরিণামদর্শী পরিচালনায় অর্থব্যবস্থার যে হাল হইয়াছে, অভ্যন্তরীণ চাহিদা যতখানি তলানিতে, কর্মসংস্থানে যে পরিমাণ ঘাটতি— তাহাতে এই ধাক্কা সামলানো বেশ কঠিন। তাহার উপর আছে রাজনীতির অঙ্ক মানিয়া অর্থনীতি পরিচালনার ভয়ঙ্কর প্রবৃত্তি। পাঁচ রাজ্যে বিধানসভা ভোট ছিল, ফলে নভেম্বর হইতে ভারতে পেট্রল-ডিজ়েলের দাম বাড়ে নাই। তেলের দামে যুদ্ধজনিত মূল্যস্ফীতি না ঘটিলেও চার মাসের বকেয়া চাপে দেশের বাজারে পেট্রল-ডিজ়েলের বিপুল মূল্যবৃদ্ধি ঘটিতই। তাহার সহিত যোগ হইল যুদ্ধের প্রভাব। ফলে, মূল্যবৃদ্ধির হার শেষ পর্যন্ত কতখানি চড়িবে, এই মুহূর্তে তাহা বিরাট প্রশ্ন। এই মূল্যবৃদ্ধি সরাসরি প্রভাব ফেলিবে বাজারে। সেখানে চাহিদা কমিবে— আশঙ্কা হয়, তাহার ফলে উৎপাদনও কমিবে, এবং ভারত আবার সেই কম চাহিদা-কম উৎপাদন-কম কর্মসংস্থানের ভয়াবহ দুষ্টচক্রে প্রবেশ করিবে। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, যুদ্ধপরিস্থিতি না পাল্টাইলে ভারতের আয়বৃদ্ধির হার দুই শতাংশ-বিন্দু অবধি কমিয়া যাইতে পারে। অর্থাৎ, উলুখাগড়াটি বিপুল বিপদের মুখে দাঁড়াইয়া আছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy