দুর্নীতিমুক্তির পরীক্ষার ফল বাহির হইয়াছে, ভারত ফের ফেল করিয়াছে। তবে গত বৎসরের চাহিতে এক ধাপ আগাইয়াছে— একশো আশিটি দেশের মধ্যে তাহার স্থান ছিয়াশি হইতে এই বৎসর হইয়াছে পঁচাশি। এই পরীক্ষায় পাশ নম্বর নাই ঠিকই, কিন্তু ভারত যে গত এক দশক একই স্থানে ঘোরাফেরা করিতেছে, ইহাই কি ব্যর্থতা নহে? প্রশাসনের জটিল ব্যবস্থার কোথায়, কোন সুযোগে দুর্নীতি ঘটিতেছে, তাহা চিহ্নিত করিবার, এবং দৃঢ় হস্তে প্রতিকার করিবার কাজটিতে বহু ছিদ্র রহিয়া গিয়াছে। যথাযোগ্য আইন প্রণয়ন বা সংস্কার হয় নাই, আইন রূপায়ণে প্রশাসনের দৃঢ়তা ও নিরপেক্ষতা দেখা যায় নাই, পুলিশি তদন্তে স্বচ্ছতা ও সক্রিয়তা, আদালতের বিচারকার্যে গতি—কোনও ক্ষেত্রেই অগ্রগতি আশ্বস্ত করিবে না। দুর্নীতি প্রতিরোধের বিধিগুলি খণ্ডিত, বিকৃত প্রয়োগ হইতেছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাহা অসার নিয়মরক্ষায় পর্যবসিত হইতেছে। তাহার কারণগুলি অজানা নহে, আলোচনাও অনেক হইয়াছে, তবু ‘ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল’ সংস্থাটির বাৎসরিক রিপোর্ট পুনরায় চিন্তা করিতে বাধ্য করে।
দুর্নীতিমুক্তির প্রতি সরকারের আগ্রহের ঘাটতি সম্ভবত সর্বাধিক প্রকট দুর্নীতির বিচারব্যবস্থার প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতায়। তথ্যের অধিকার কমিশন, মানবাধিকার কমিশন, মহিলা অথবা সংখ্যালঘুদের অধিকারের সুরক্ষার কমিশনগুলি স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান হিসাবে নির্মিত হইয়াছিল, যাহাতে প্রশাসনিক ক্ষমতার অপপ্রয়োগ রুখিতে পারে। দেশের সাধারণ নাগরিক যে কোনও প্রকার দুর্নীতির শিকার হইলে সরাসরি কমিশনের নিকট আবেদন করিতে পারেন। বিশেষত পুলিশের দুর্নীতির বিরুদ্ধে নাগরিকের ক্ষোভ সকল রাজ্যেই প্রবল, মানবাধিকার কমিশনে সর্বাধিক আবেদন তাহার বিরুদ্ধেই জমা পড়িয়াছে বরাবর। প্রশাসনের যে কোনও স্তরের আধিকারিকদের তিরস্কার করিবার ও শাস্তি সুপারিশ করিবার ক্ষমতা কমিশনগুলির রহিয়াছে, স্বতন্ত্র ভাবে দুর্নীতির তদন্তও তাহারা করিতে পারে। এই বিপুল শক্তি থাকিবার জন্যই হয়তো কমিশনগুলিকে ঢাল-তরোয়ালহীন নিধিরাম সর্দার করিতে উদ্যত কেন্দ্র ও রাজ্য, সকল স্তরের সরকার। বহু পদ শূন্য রাখিয়া, অতি গুরুত্বপূর্ণ পদগুলিতে শাসক দল-অনুগত ব্যক্তিদের বসাইয়া, আর্থিক অনুদান নিয়ন্ত্রণ করিয়া, সর্বপ্রকারে কমিশনগুলির স্বাতন্ত্র্য খর্ব করা হইতেছে। আদালতগুলির অবস্থাও তথৈবচ, শূন্য পদ এবং দুর্বল পরিকাঠামোর কারণে বিলম্বিত বিচারই নিয়ম হইয়া উঠিয়াছে। এই ব্যবস্থা দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিতেছে।
দুর্নীতি লুকাইতে দ্বিতীয় যে উপায় অবলম্বন করিতেছে সকল স্তরের প্রশাসন, তাহা তথ্য গোপন রাখিবার প্রচেষ্টা। গ্রাম পঞ্চায়েত গ্রামসভায় অডিট রিপোর্ট প্রকাশ করিবার সংবিধান-নির্দিষ্ট কর্তব্য এড়াইতে গ্রামসভা আহ্বান করে না, রাজ্য সরকারের অধিকাংশ বিভাগ বরাদ্দ-ব্যয়ের বার্ষিক রিপোর্ট প্রকাশ করে না, কেন্দ্রীয় সরকার বিবিধ সমীক্ষার রিপোর্ট চাপিয়া যায়। দুর্নীতিগ্রস্তদের উপর নজরদারির পরিবর্তে, দুর্নীতি প্রকাশকারীর উপরে নজর রাখিতে কেন্দ্র অধিক আগ্রহী, এমন আরোপকে পুষ্ট করিয়াছে ‘পেগাসাস’ স্পাইওয়্যার ব্যবহারের অভিযোগ। আন্তর্জাতিক সংস্থাটির রিপোর্টে বলা হইয়াছে, ভারতে সাংবাদিক ও অধিকার কর্মীরা বিপন্ন, তাঁহাদের উপর পুলিশ অথবা সরকারি মদতপ্রাপ্ত দুষ্কৃতীদের আঘাত নামিয়া আসিতেছে। কথাটি অজানা নহে, সংবাদের স্বাধীনতার সূচকে ভারতের স্থান লজ্জাজনক, নাগরিকের মানবাধিকার ভঙ্গ করিবার অভিযোগও বার বার উঠিয়াছে। ইহাই প্রত্যাশিত— মিথ্যার সহিত হিংসার সম্পর্ক অতি ঘনিষ্ঠ, মনে করাইয়াছিলেন মহাত্মা গান্ধী। দিগন্ত আজও অবগুণ্ঠিত, আপন শক্তিতে সত্যের পথে শঙ্কাপূর্ণ যাত্রা শীঘ্র শেষ হইবে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy