সমাজমাধ্যমকে যদি প্রদীপের সঙ্গে তুলনা করা যায়, তার তলার অন্ধকারটি নিঃসন্দেহে ট্রোলিং। একুশ শতকে সমাজমাধ্যম-নির্ভরতা যত বাড়ছে, পাশাপাশি বেড়ে চলেছে অন্যকে কটূক্তি ও ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের প্রবণতা: ঔচিত্য, সৌজন্য ও শ্লীলতার গণ্ডি ভেঙে অনেক সময় তা পৌঁছে যাচ্ছে হেনস্থা ও হুমকির পর্যায়ে। দেখা যাচ্ছে, ট্রোলিং-এর শিকার হতে পারেন যে কেউ, যে কোনও পরিস্থিতিতে, কারণে ও অকারণেও: নামকরা ব্যক্তিত্ব বা সাধারণ মানুষে কোনও প্রভেদ নেই। সমাজমাধ্যমের গণতান্ত্রিক চরিত্রটিই এ কাজ সহজ করে দিয়েছে: যে বিশিষ্ট ও বিখ্যাতরা একদা ছিলেন সাধারণের ধরাছোঁয়ার বাইরে, এখন অতি সহজেই তাঁদের কাজকর্ম জীবনযাত্রার খবর মিলছে সমাজমাধ্যমে, আর তার যে কোনও কিছুই নিমেষে হয়ে উঠছে ট্রোলিং-এর লক্ষ্য। মনোবিদরা বলছেন, ট্রোল যাঁরা করেন তাঁদের ভিতরে রয়েছে আত্মসম্মানহীনতা, আত্মমগ্নতা, এমনকি বিকৃত মানসিকতার বোধও। তা থেকেই আসে সমাজমাধ্যমে দৃষ্টি আকর্ষণের প্রবণতা, অন্যের বৈধতার প্রত্যাশা। অকথা-কুকথা সহজেই নজর কাড়ে, সমর্থনও জুটে যায়।
ট্রোলিং-এর ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সুবিধা আন্তর্জালের আড়াল। সামনাসামনি যে কথা বলতে যে কেউ দু’বার ভাববেন, সমাজমাধ্যমে তা শুনিয়ে দিতে তাঁরাই পিছপা হচ্ছেন না— এর পিছনে রয়েছে এই নিশ্চিন্তি: মুখোমুখি সাক্ষাতের সুযোগ কম, প্রায় নেই। এমনও দেখা গিয়েছে, ট্রোলের শিকার মানুষটি ট্রোলকারীর সঙ্গে দেখা করে তাঁর কদাচরণের কারণ জানতে চাওয়ায় ট্রোলকারী চরম লজ্জায় পড়ে গিয়েছেন। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে, সমাজমাধ্যমে যিনি কাউকে কুৎসিত ভাষায় কথা বলছেন, এমনিতে তিনি সহজ স্বাভাবিক জীবনযাপন করা মানুষ: স্নেহশীল পিতা, দায়িত্ববান স্বামী বা সন্তান। অথচ প্রযুক্তিকে ঢাল করে তিনিই সমাজমাধ্যমে অমানবিক আচরণ করছেন অন্যের প্রতি। আবার রাজনৈতিক দলগুলির আই টি সেল-এর হাতে পড়ে এই ট্রোলিং-ই পৌঁছে যাচ্ছে কদর্যতম স্তরে, বিরোধী মতাদর্শের বা প্রতিবাদী যে কাউকে টেনে নামাতে ব্যবহার করা হচ্ছে চরিত্রহননের মতো অস্ত্র। সমাজমাধ্যমে ট্রোলিং নিয়ে যথাযথ আইনের অভাবের সুযোগও নেওয়া হচ্ছে পুরোদমে, কেউ প্রতিবাদ করলে শুনিয়ে দেওয়া হচ্ছে স্বাধীন সার্বভৌম দেশে বাক্স্বাধীনতার কথা।
বাক্স্বাধীনতা মানেই যে যা খুশি বলা নয়, আইন নেই বলেই যে যদৃচ্ছাচার করা যায় না, যাঁরা ট্রোল করেন তাঁদের এ কথা বলে বোঝানো যাচ্ছে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন ট্রোলিংকে উপেক্ষাই এর ওষুধ, ট্রোলকারী তখন হাওয়া কাড়তে না পেরে চুপ করে যাবেন। কিন্তু ট্রোলিং-এর শিকার যাঁরা, তাঁদের মনে ও কাজেকর্মে এর যে প্রভাব পড়ে তা অত্যন্ত গুরুতর। কুমন্তব্য, চরিত্র-হনন ইত্যাদির প্রভাব খ্যাত বা অখ্যাতের উপরে পড়ে সমান ভাবে, অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েন, তার ছায়া পড়ে ব্যক্তিগত থেকে পারিবারিক বা পেশাগত প্রতিটি পরিসরে। এমন বহু দুর্ভাগ্যজনক উদাহরণ উঠে আসছে সমাজমাধ্যমেই, কেউ তার পরিণতিতে সমাজমাধ্যম থেকে বিদায় নিচ্ছেন। পরিবর্তিত মূল্যবোধের এই সমাজে মানুষের শুভবোধের চর্চা প্রত্যাশিত, কিন্তু শুধু আশাবাদে কাজ হবে না। প্রয়োজন ট্রোলিং-এর বিরুদ্ধে যথাযথ প্রাতিষ্ঠানিক পদক্ষেপ। ট্রোলিং-এর ব্যাধি যেন প্রশাসন ও আইনও হালকা ভাবে না নেয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy