Advertisement
২৪ ডিসেম্বর ২০২৪

 অক্ষমণীয়

মুখ্য নির্বাচন কমিশনারকে প্রধানমন্ত্রীই নিয়োগ করেন বটে, কিন্তু তিনি তাঁহাকে আদেশ বা অনুরোধ করিবার অধিকারী নহেন।

শেষ আপডেট: ২৪ ডিসেম্বর ২০২১ ০৬:২৯
Share: Save:

আদেশ নহে, অনুরোধমাত্র— জানাইয়াছে প্রধানমন্ত্রীর দফতর। প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব দেশের মুখ্য নির্বাচন কমিশনার ও তাঁহার সহকর্মী দুই নির্বাচন কমিশনারকে ‘অনুরোধ’ করিয়াছিলেন প্রধানমন্ত্রীর দফতরে হাজির হইয়া কিছু বিষয়ে আলোচনা করিতে। প্রধানমন্ত্রীর সচিব দূরস্থান, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীরও এই ‘অনুরোধ’ করিবার এক্তিয়ার নাই। কারণ, দেশের সংবিধান দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানাইয়াছে যে, নির্বাচন কমিশন নামক প্রতিষ্ঠানটি স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীরও অধীন নহে। তাহা সম্পূর্ণ রূপে স্বশাসিত একটি প্রতিষ্ঠান, শুধুমাত্র সংবিধানের প্রতি দায়বদ্ধ। দেশের শীর্ষ আদালত যেমন। মুখ্য নির্বাচন কমিশনারকে প্রধানমন্ত্রীই নিয়োগ করেন বটে, কিন্তু তিনি তাঁহাকে আদেশ বা অনুরোধ করিবার অধিকারী নহেন। নির্বাচন কমিশনারকে ঘিরিয়া এই প্রাচীরটি এমনই অলঙ্ঘ্য যে, কোনও আইএএস আধিকারিককে নির্বাচন কমিশনারের পদে নিয়োগ করিতে হইলে তাঁহাকে প্রথমে চাকুরি হইতে পদত্যাগ করিতে হয়— কোনও পরিস্থিতিতেই যেন তিনি প্রধানমন্ত্রীর অধীন না থাকেন, তাহা নিশ্চিত করিতেই এই ব্যবস্থা। কাজেই, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের— প্রকৃত প্রস্তাবে প্রধানমন্ত্রীর— এই আচরণটি এক্তিয়ার উল্লঙ্ঘন তো বটেই, তাহা সাংবিধানিক শিষ্টতার পরিপন্থী। এক অক্ষমণীয় অন্যায়।

সংবিধান কেন মুখ্য নির্বাচন কমিশনারকে সম্পূর্ণ স্বাতন্ত্র্য দিয়াছে, তাহা সহজবোধ্য। এই প্রতিষ্ঠানটি নির্বাচনী গণতন্ত্রের দ্বাররক্ষক। যাহাতে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হইতে পারে, তাহা নিশ্চিত করাই নির্বাচন কমিশনের কাজ। কোনও রাজনৈতিক ক্ষমতার নিকটই তাহার নতজানু হইলে চলে না। প্রতিষ্ঠানটি, বা তাহার প্রধান যদি প্রধানমন্ত্রীর অধীনে থাকেন, তবে স্বভাবতই নির্বাচনের ময়দানে অন্য দলগুলির সহিত ক্ষমতাসীন দলের পার্থক্য হইয়া যায়। তাহা হইলে, নির্বাচনী ময়দানে সকল দলের সমান প্রাতিষ্ঠানিক গুরুত্ব বজায় রাখিবার আর উপায় থাকে না। মুখ্য নির্বাচন কমিশনারের সহিত রাজনৈতিক দলের নেতারা আলোচনা করিয়াই থাকেন— কিন্তু, দলের নেতা হিসাবে, উপরওয়ালা হিসাবে নহে। মন্ত্রী হিসাবেও আলোচনা করা সম্ভব, উচিতও বটে— এবং, তেমন আলোচনা হামেশাই হইয়া থাকে— কিন্তু তাহার জন্য নির্বাচন কমিশনারকে নিজের দফতরে তলব করা চলে না, বরং মন্ত্রিবরকেই কমিশনের দফতরে আসিতে হয়। কোনও প্রশ্নে যদি কমিশন আলোচনার প্রয়োজন অনুভব করে, তখনও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী বা আধিকারিককে কমিশনের দফতরে তলব করাই দস্তুর। এবং, সেই আলোচনা সম্পূর্ণত গণপরিসরে প্রকাশ করাই রীতি। ইহা পরিহারযোগ্য আনুষ্ঠানিকতা নহে, নিরপেক্ষতা বজায় রাখিবার অপরিহার্য ব্যবস্থা। নির্বাচন কমিশনকে নিরপেক্ষ থাকিতে হইবে, ইহাই যথেষ্ট নহে— জনসাধারণের চোখে কমিশনকে নিরপেক্ষ প্রতিপন্ন হইতে হইবে।

অনুমান করা চলে যে, এই স্বাতন্ত্র্য, এই নিরপেক্ষতাকে ধ্বংস করিবার উদ্দেশ্যেই প্রধানমন্ত্রীর দফতর হইতে মুখ্য নির্বাচন কমিশনারকে তলব করা হইয়াছিল। অভিজ্ঞতা বলিতেছে, প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের নিরপেক্ষতা, বিশ্বাসযোগ্যতাকে ধ্বংস করিয়া তাহাকে খাঁচার তোতায় পরিণত করাই বর্তমান শাসকদের দস্তুর। গণতন্ত্রের হাত-পা ভাঙিয়া, তাহাকে একটি অবান্তর অনুষঙ্গে পরিণত করিবার যে গৈরিক প্রকল্প উদ্বেগজনক ধারাবাহিকতায় চলিতেছে, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে ধ্বংস করা তাহারই অপরিহার্য অঙ্গ। দুর্ভাগ্য, প্রতিষ্ঠানগুলিও শিরদাঁড়া সোজা রাখিতে নারাজ। মুখ্য নির্বাচন কমিশনারও কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর দফতরে যাইবার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেন নাই, তাহার সাংবিধানিক অগ্রহণযোগ্যতার কথা গণপরিসরে উচ্চারণ করেন নাই। শাসকদের রাজনৈতিক প্রকল্প কি এই প্রশ্নহীন আনুগত্যই কামনা করে না?

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy