Advertisement
২৬ ডিসেম্বর ২০২৪

জয়রথ

স্বার্থসংঘাত এত চরম হইলে আদৌ কোনও বিরোধী পরিসর পাইবার আশা কোথায়।

শেষ আপডেট: ১৪ মার্চ ২০২২ ০৫:২০
Share: Save:

যে  ভাবে চার রাজ্যে জয় নিশ্চিত করিয়া প্রধানমন্ত্রী মোদী ইতিমধ্যেই পরবর্তী নির্বাচনের লক্ষ্যে প্রচারাভিযানে নামিয়া পড়িয়াছেন, তাহাতে প্রাচীন ভারতের একটি চালু প্রথা মনে পড়িতে পারে: অশ্বমেধ যজ্ঞ। সাম্রাজ্যপ্রতিষ্ঠার অভীপ্সার্থে আয়োজিত এই যজ্ঞের প্রকৃত লক্ষ্য ছিল, প্রশ্নাতীত শ্রেষ্ঠত্বের ঘোষণা। নরেন্দ্র মোদী এখন ভারতজয়কে ঠিক সেই অপ্রতিরোধ্য সাম্রাজ্যবিস্তারের চোখেই দেখিতেছেন— উত্তরপ্রদেশে বিপুল মাত্রার জয়ের পর হিন্দুহৃদয়সম্রাট হিসাবে তাঁহার নিজেকে প্রতিষ্ঠার দাবিটি প্রায়-বাস্তব হইয়া দাঁড়াইয়াছে। হারজিতের জটিল অঙ্ক ছাপাইয়া আপাতত এই সত্যটি স্বীকার করা জরুরি। ইহাও স্পষ্ট যে, উত্তরপ্রদেশে যোগী আদিত্যনাথ পর পর দুই বার মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে ইতিহাস গড়িতে চলিলেও, এবং সর্বভারতীয় বিজেপি-তে তাঁহার বৃহত্তর উত্থানের সম্ভাবনা দৃষ্টিগোচর হইলেও, সে রাজ্যের ভোটবাক্সের এই বিপুল জাদুটি ঘটাইবার প্রধান কৃতিত্ব কিন্তু প্রধানমন্ত্রী মোদীরই। জাতধর্মে বহুধাবিভক্ত এই রাজ্যে হিন্দুত্ববাদের জয়রথ এ বার কোনও চ্যালেঞ্জের মুখেই পড়িল না। এই মহাজয়ের পশ্চাতে কতখানি রামলালার মন্দির নির্মাণের আবেগ, আর কতখানি প্রবলপুরুষের প্রতি ভক্তিসিঞ্চিত আস্থা, এই সকল কাটাছেঁড়া রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা করিবেন; সমাজ-মনোবিশ্লেষকরাও। তবে কি না, কোভিড বিপর্যয় ও কোভিড-পূর্ববর্তী অর্থনৈতিক সঙ্কটের প্রবল আঘাতও যে ভাবে ক্ষমতাসীন নেতার ভাবমূর্তির গায়ে আঁচড়মাত্র কাটিতে পারিল না, বরং তাঁহার প্রতি আস্থা বাড়াইয়া তুলিল— তাহা কেবল ভোটপ্রার্থী নেতাদের বিষয়ে বিশ্লেষণ দাবি করে না, ভোটার সমাজকেও নূতন করিয়া চিনাইয়া দেয়।

ভোটার সমাজ চেনার কাজটি জরুরি ভোটকে শ্রেণি-গোষ্ঠী-লিঙ্গভেদে বুঝিবার জন্যও। যে রাজ্য গত পাঁচ বৎসরে বিশৃঙ্খলা ও অনাচারের শো-কেস হইয়া উঠিয়াছে, বিশ্বময় কুখ্যাতি অর্জন করিয়াছে, উন্নাও হইতে হাথরস, ভয়ঙ্করতার একের পর এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করিয়াছে, বর্ষব্যাপী কৃষক-অভ্যুত্থানে যে রাজ্য হইতে প্রতিনিধিত্ব ও নেতৃত্ব আসিয়াছে, যে রাজ্যে দলিত গ্রামে নির্যাতনের দুঃসংবাদে অবশিষ্ট ভারত নিয়মিত কাঁপিয়া উঠিয়াছে, স্বঘোষিত গোরক্ষকদের অত্যাচারে, নিধন-নির্যাতনে দরিদ্র মুসলমানরা অতিষ্ঠ হইয়াছেন, লাভ-জেহাদের আস্ফালন শেষে আইনে পরিণত হইয়া সম্প্রদায়-সম্পর্কের শিকড়টিকে উপড়াইবার উপক্রম করিয়াছে, সেখানে যত পরিমাণ ভোটে শাসক দল জিতিল, আশ্চর্য— তাহার পিছনে কৃষক গোষ্ঠী, নারীসমাজ, দলিত সমাজ কিংবা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিরাট ভোট-আশীর্বাদ সাধারণ অঙ্কের হিসাবেই ধরা পড়ে।

সেই হিসাব অবশ্য বলিতেছে, বিজেপির সাফল্যের অপেক্ষা বিরোধীদের ব্যর্থতা একই রকম গুরুত্বের সহিত বিবেচ্য। তাঁহাদের প্রবল অনৈক্য বিজেপি নেতাদের অনেক ক্ষেত্রে কঠিন পরিশ্রম ছাড়াই জিতাইয়া দিয়াছে। সুতরাং, প্রথম প্রশ্ন, জনক্ষোভ যথেষ্ট ছিল কি না। দ্বিতীয় প্রশ্ন, সেই ক্ষোভ থাকিলেও কেন বিরোধীরা গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করিতে পারিল না। এই দফার আগেও যে নির্বাচনগুলি ঘটিয়াছে, তাহাতে জানা গিয়াছিল যে বিজেপিকে আটকাইতে গেলে বিরোধীদের প্রথম কাজ— ঐক্যবদ্ধতা। এত স্পষ্ট দেওয়াল-লিখন থাকা সত্ত্বেও তাহা পড়া গেল না কেন? স্বার্থসংঘাত এত চরম হইলে আদৌ কোনও বিরোধী পরিসর পাইবার আশা কোথায়। আর বিরোধী পরিসর না হইলে আগামী বিধানসভা ভোটসমূহ ও পরবর্তী লোকসভা ভোটে সত্যকারের ভোট-যুদ্ধ হইবে কী করিয়া। মহাভারত কিন্তু বলিতেছে, সে কালে অশ্বমেধের ঘোড়াকেও কেহ কেহ রাশ টানিয়া ধরিতেন, চ্যালেঞ্জ ছুড়িতেন। মাঝেমধ্যে জিতিতেনও।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy