Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪
Manipur

দাবানলের ভয়

অনেক দিনের অবহেলা ও টালবাহানার পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ শেষ পর্যন্ত গেলেন বটে মণিপুরে, কিন্তু হত্যা ও ধ্বংসের মিছিল অব্যাহত রইল।

Manipur Violence.

একটি জ্বলন্ত রাজ্যের আগুন নেবানো গেল না। ছবি: রয়টার্স।

শেষ আপডেট: ১৬ জুন ২০২৩ ০৪:৪৬
Share: Save:

এক মাসেরও বেশি পেরিয়ে গেল। একটি জ্বলন্ত রাজ্যের আগুন নেবানো গেল না। অনেক দিনের অবহেলা ও টালবাহানার পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ শেষ পর্যন্ত গেলেন বটে মণিপুরে, কিন্তু হত্যা ও ধ্বংসের মিছিল অব্যাহত রইল, কোনও সমাধানে আসতে পারলেন না শীর্ষনেতা। বরং আক্রমণের নৃশংসতা যেন আপাতত আরও ঊর্ধ্বমুখী— শিশু-সহ মাকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারার ঘটনা ত্রাসের শিহরন তুলেছে গোটা দেশে। সেনা, আধাসেনা, কে কী করতে পারবে, সেটা কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকেরই বিচার্য। এটুকু কেবল দেশের নাগরিক সমাজের দিক থেকে দাবি, সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা ফিরে আসুক। রাজনৈতিক জট খোলাও জরুরি, কিন্তু সব পক্ষের মতের আদানপ্রদানের মধ্যে দিয়ে জট খুলতে যদি আরও কিছুটা সময়ও লাগে, দৈনন্দিন জীবনের এই ভয়ঙ্কর অরাজকতা ও হিংসা এখনই বন্ধ করা অত্যন্ত জরুরি। বাস্তবিক, এর থেকে জরুরি কাজ কিছু আর নেই গোটা দেশের পরিপ্রেক্ষিতে। কেন্দ্রীয় সরকার কত ‘সবল’ ভাবে নাগরিক জীবন পাল্টে দিতে পারেন, কাশ্মীর উপত্যকায় সাম্প্রতিক কালে তা প্রমাণিত হয়েছে। মণিপুরের অবস্থা এই মুহূর্তে তার চেয়ে বেশি ভয়ানক বললে অত্যুক্তি হবে না। অথচ সেই ‘সবলতা’, উদ্যম বা উদ্যোগ কোথায়? বিদেশি নেতাদের প্রশংসা কুড়িয়ে দেশের মানুষের কাছে সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে দিতে প্রধানমন্ত্রী অতি প্রগল্‌ভ। কিন্তু দেশের ভিতরে একটি গোটা প্রদেশে যে এক দিকে নাগরিকরা ভয়ার্ত হয়ে প্রায় লুকিয়ে দিন অতিবাহন করছেন, এবং অন্য দিকে আক্রমণমুখী জনতা জ্বালিয়ে পুড়িয়ে-ভেঙে কুরুক্ষেত্র চালিয়ে যাচ্ছে— তাতে তাঁর নীরবতা অনমনীয়, অচ্ছেদ্য।

সামাজিক পরিচয়ে উন্নীত কিন্তু প্রাত্যহিক অর্থনৈতিক সচ্ছলতার দিক থেকে পিছিয়ে-থাকা মেইতেই জনগোষ্ঠীর ‘জনজাতি’ হিসাবে মান্যতা দেওয়ার নতুন যে প্রশাসনিক উদ্যোগ, তার থেকেই এই অগ্নিবর্ষী পরিস্থিতি। মেইতেইদের অভিযোগ, জনজাতি সংরক্ষণের কারণেই তারা পিছিয়ে পড়ছে। এই অভিযোগে এবং প্রশাসনিক তরফে মেইতেইদের সংরক্ষণভুক্ত করার উদ্যোগের পরিপ্রেক্ষিতে উত্তাল হয়ে উঠেছে কুকি, নাগা, চিন ও অন্যান্য জনজাতি। মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিংহ নিজে মেইতেই গোষ্ঠীভুক্ত, এবং প্রশাসনের অধিকাংশ ক্ষমতাশালীই তা-ই, সুতরাং জনজাতি-মানসে ধারণা যে তাদের লড়াই করেই নিজেদের ‘জায়গা’ বজায় রাখতে হবে। কুকি বিধায়করা দিল্লি গিয়ে আলাদা করে প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে আলাদা শাসনাঞ্চল দাবি করেছেন, তার থেকেই বোঝা যায় কত গভীর তাঁদের ক্ষোভ ও আশঙ্কা। কিন্তু এ কেবল মণিপুরের সমাজের খণ্ড ও সমগ্রের সম্পর্কের প্রশ্ন নয়। কেন্দ্রীয় সরকার নিশ্চয়ই অবহিত, কত সুদূরপ্রসারী হতে পারে মণিপুরের ঘটনার ফল। কাকে জনজাতি পরিচিতি দেওয়া হবে আর কাকে হবে না, এই প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের রেশ পড়তে পারে অন্য বহু রাজ্যে, উত্তর-পূর্বে তো বটেই পূর্ব, পশ্চিম এবং মধ্য ভারতেরও বিস্তৃত অঞ্চলে। আক্ষরিক অর্থেই এ হল আগুন নিয়ে খেলা। সুতরাং, সংঘর্ষ ও সঙ্কটের সমাধানটি কেবল মানবিক কারণেই অতীব জরুরি নয়— প্রশাসনিক কারণেও এ বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ করা দরকার। আগুন কখন দাবানল হয়, তার হিসাব মানুষ ঠিক ভাবে কষতে পারলে আজ দাবানল বস্তুটিই পৃথিবীতে থাকত না।

অথচ স্পষ্টতই, অন্য বহু ক্ষেত্রের মতোই, এখানেও কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের সঙ্কীর্ণ রাজনৈতিক কৌশলরচনা চলছে। কুকি নেতাদেরও এই দাবি পেশের পিছনে আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে চাপ তৈরি করার চেষ্টা আছে বইকি। এবং বিজেপির দিক থেকেও পরিষ্কার: মেইতেই স্বার্থ রক্ষা যেমন শাসকের কাছে জরুরি, পুরনো জনজাতিদের থেকে দূরে সরে যাওয়ার ভোট-ফল প্রবল ‘ক্ষতি’কারক হতে পারে। এই সাঁড়াশির চাপে পিষ্ট হচ্ছেন বলেই নেতাদের এ-হেন অটল অপার নীরবতা। মাঝখান থেকে, সঙ্কট ক্রমেই ব্যাপ্ত ও গভীর হয়ে উঠছে মণিপুরে।

অন্য বিষয়গুলি:

Manipur Manipur Violence
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE