রাষ্ট্রদ্রোহ আইনটি বহাল রাখতে চায় আইন কমিশন। প্রতীকী ছবি।
দেশের সংহতি রক্ষা এবং মৌলবাদের মোকাবিলার জন্য রাষ্ট্রদ্রোহ আইনটি বহাল রাখতে চায় আইন কমিশন। অবশ্য আইনে কিছু সংশোধনও চায়। যেমন সরকার-বিরোধী বক্তব্যে হিংসা উদ্রেকের ‘প্রবণতা’ দেখা গেলেই তাকে রাষ্ট্রদ্রোহিতা বলা যেতে পারে, হিংসাত্মক কার্যকলাপ যে ঘটেছে, তার প্রমাণ দরকার নেই। কারাদণ্ডের মেয়াদও বাড়াতে চায় কমিশন, তিন বছর থেকে অন্তত সাত বছর। অর্থাৎ আইনটি আরও কঠোর করতে চায় কমিশন। প্রশ্ন উঠবে, ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২৪এ ধারাটি ভীতিপ্রদর্শন ও হয়রানির জন্য যে ভাবে প্রয়োগ করা হয়েছে বিরোধী ও সমালোচকদের উপরে, কমিশন কি সে বিষয়ে অন্ধকারে? কেবল নরেন্দ্র মোদী সরকারের আমলেই (২০১৫-২০২০) ৩৫৬টি রাষ্ট্রদ্রোহের মামলায় ৫৪৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়,যদিও আজ অবধি মাত্র বারো জনকে দোষী সাব্যস্ত করা গিয়েছে। সংবাদের স্বাধীনতার সূচকে এই সময়কালে ভারতের স্থান দ্রুত নীচে নেমেছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্ট গত বছর মে মাসে কেন্দ্রীয় সরকারকে আইনটি পর্যালোচনা করার নির্দেশ দেয়, এবং তা না হওয়া অবধি ১২৪এ ধারায় নতুন মামলা নথিভুক্ত করতে নিষেধ করে। রাষ্ট্রদ্রোহিতা নিয়ে গত কয়েক বছর গণপরিসরে এবং আদালতে এই আইনটি নিয়ে যা কিছু বিতর্ক হয়েছে, যে সব সংশয় এবং আশঙ্কা সামনে এসেছে, আইন কমিশন তার কোনও কিছুকেই আমল দেয়নি।
কমিশনের বক্তব্য, কেবল ঔপনিবেশিক আমলে তৈরি বলেই রাষ্ট্রদ্রোহিতার আইনটি বাতিল করা চলে না। ভাবখানা যেন, পুরনো হলেই কি আর ফেলনা হয়? বস্তুত ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২৪এ ধারায় ঔপনিবেশিকতার মৌলিক চরিত্রটি বিধৃত রয়েছে। তা হল, নিপীড়নের মাধ্যমে শাসন। সরকারের প্রতি অপ্রীতি তৈরি করতে পারে, তেমন কোনও কথা বলা বা লেখাই আইনত রাষ্ট্রদ্রোহিতা। ১৯২২ সালে এই আইনে অভিযুক্ত হয়েছিলেন মহাত্মা গান্ধী। তিনি নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের চেষ্টা করেননি, বরং আইনটির বিরুদ্ধেই সওয়াল করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, আইনের দ্বারা সরকারের প্রতি প্রীতি তৈরি করা যায় না। যদি কোনও ব্যক্তি বা ব্যবস্থার প্রতি কারও ক্ষোভ থাকে, তবে মুক্তকণ্ঠে তা বলার স্বাধীনতা তার থাকা উচিত, যতক্ষণ না সে হিংসায় ইন্ধন জোগাচ্ছে। এই কথাগুলি বাক্স্বাধীনতা এবং নাগরিকের অধিকারের বিজয়কেতন। ব্রিটেন-সহ বহু দেশ রাষ্ট্রদ্রোহ আইন বাতিল করে দিয়েছে, প্রধানত তা বাক্স্বাধীনতার পরিপন্থী বলে। আইন কমিশন অবশ্য মনে করে, সাত বছর থেকে আজীবন কারাদণ্ডের সম্ভাব্য সাজা বাক্স্বাধীনতায় ‘যুক্তিসঙ্গত’ সীমাবদ্ধতা। একটিই সুরক্ষা কবচ সুপারিশ করেছে কমিশন— কোনও উচ্চপদস্থ পুলিশ আধিকারিক প্রাথমিক তদন্তে অভিযোগের সারবত্তা পেলে তবেই রাষ্ট্রদ্রোহিতার ধারা দেওয়া যায়। এতে আশ্বস্ত হওয়া কঠিন। রাজনৈতিক বাহুবলী বা তাঁর অনুচরদের দায়ের করা অভিযোগকে খারিজ করবে পুলিশ, তার সম্ভাবনা কতটুকু?
সবচেয়ে চমকপ্রদ কমিশনের এই যুক্তি যে, রাষ্ট্রদ্রোহ আইন বাতিল করলে ‘রাষ্ট্রবিরোধী’ কার্যকলাপে অভিযুক্তদের উপর ইউএপিএ-র মতো কঠোরতর আইনের প্রয়োগ হতে পারে, অতএব রাষ্ট্রদ্রোহের আইন ‘মন্দের ভাল’। অহো, নাগরিকের সুরক্ষার জন্য কত মাথাব্যথা! সত্যিই তো, ছোটখাটো অস্ত্র কেড়ে নিলে গোড়াতেই যদি সন্ত্রাস-বিরোধিতার ‘ব্রহ্মাস্ত্র’ প্রয়োগ করে বসে সরকার? বাক্স্বাধীনতার দাবি তুলছে যে নাগরিক সমাজ, তাকে ইউএপিএ-র ভয় দেখিয়ে কমিশনের সদস্যরা বোঝালেন, রাষ্ট্রকে তাঁরা নাগরিকের প্রতিপক্ষ বলেই মনে করেন, রক্ষক বলে নয়। এই হল ঔপনিবেশিক শাসনের স্বরূপ। ভারত যে-হেতু কল্যাণকামী রাষ্ট্র, প্রজাতন্ত্র ও গণতন্ত্র, আইন কমিশনের এই অসার, জনবিরোধী রিপোর্টকে পত্রপাঠ বাজে কাগজের ঝুড়িতে ফেলা দরকার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy