টুইটার। —ফাইল চিত্র।
অনুমানই তো আসল প্রমাণ। যাকে তোমরা প্রত্যক্ষ প্রমাণ বলে থাকো, তাকে বিশ্লেষণ করলে কতকগুলো অনুমান বৈ আর কিছুই থাকে না।” উদ্ধৃতিটি সত্যান্বেষী ব্যোমকেশ বক্সীর, পথের কাঁটা উপন্যাসের গোড়ার দিকেই রয়েছে। টুইটারের সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং ভূতপূর্ব সিইও জ্যাক ডরসি নরেন্দ্র মোদী সরকার বিষয়ে যে কথাগুলি বলেছেন, তার মধ্যেও প্রত্যক্ষ প্রমাণ নেই। কিন্তু, প্রত্যক্ষ প্রমাণ নেই বলেই ডরসির কথাগুলিকে উড়িয়ে দেওয়া বিধেয়? টুইটারের সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারের যে বিরোধ আছে, তার বিবিধ প্রমাণ গত কয়েক বছরে মিলেছে। ডরসি যে সময়ের কথা বলেছেন, অর্থাৎ কৃষক আন্দোলন চলাকালীন, সেই সময়কালে যে বিরোধ চরমে উঠেছিল, সে কথাও স্পষ্ট। তখন সরকারি নির্দেশে সেই আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত বেশ কিছু সমাজকর্মী, সাংবাদিক ও কিছু প্রতিষ্ঠানের টুইটার অ্যাকাউন্ট সাময়িক ভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়— পরে টুইটার তা ফের চালু করে। ঘটনাক্রমে, তার কিছু দিনের মধ্যেই টুইটারের ভারতীয় সদর দফতরে পুলিশি তল্লাশি হয়। পুরনো সংবাদপত্র ঘাঁটলে দেখা যাবে যে, সে সময় ‘নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক’ এক সরকারি কর্তা বলেছিলেন, টুইটারের কিছু কর্মীকে গ্রেফতারও করা হতে পারে। ২০২২ সালের জুলাই মাসে টুইটার কর্নাটকের তৎকালীন বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করে— অভিযোগ, সরকার হুমকি দিচ্ছিল যে, সরকার-নির্দেশিত কিছু অ্যাকাউন্ট বন্ধ না করে দিলে সংস্থার আধিকারিকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। বিরোধের নিদর্শনের তালিকাটি দীর্ঘতর করা অনাবশ্যক। প্রধানমন্ত্রী মোদীর সঙ্গে বৈঠকের পর টুইটারের বর্তমান কর্ণধার ইলন মাস্ক ডরসির অভিযোগ সম্বন্ধে যা বললেন, সেই কথাগুলিও অভিযোগের যাথার্থ্য সম্বন্ধে ইঙ্গিতবাহী।
তর্কের খাতিরে যদি ধরে নেওয়া যায় যে, বিজেপি সরকার এবং টুইটারের সম্পর্কটি সুমধুর ছিল না, তবুও কি শুধু সেটুকুর ভিত্তিতেই দাবি করা যায় যে, সরকার টুইটারকে হুমকি দিয়েছিল, কথা না শুনলে ভারতে ব্যবসা বন্ধ করে দেওয়া হবে? মূলধারার সংবাদমাধ্যম, বিশেষত টেলিভিশন চ্যানেলের উপর সরকারপক্ষের রাজনৈতিক প্রভাব যত প্রবল হয়েছে, বিরুদ্ধ স্বরের পক্ষে টুইটারের মতো প্ল্যাটফর্মের গুরুত্ব ততই বেড়েছে— বৃহত্তর জনসাধারণের কাছে নিজেদের কথা পৌঁছে দেওয়ার জন্য সমাজমাধ্যমের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। বৈশ্বিক অভিজ্ঞতা বলছে যে, ক্ষমতার অঙ্গুলিহেলনে চলতে ফেসবুক যতখানি ইচ্ছুক এবং প্রস্তুত, জ্যাক ডরসির নেতৃত্বাধীন টুইটার তা ছিল না। বরং, গোটা দুনিয়াতেই অগণতান্ত্রিক শাসকের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল টুইটার। ভারতেও নতুন নাগরিকত্ব আইনবিরোধী আন্দোলন এবং কৃষক আন্দোলনের সময় সরকারবিরোধী পক্ষ টুইটারকে ব্যবহার করেছিল রাজনৈতিক সংগঠন ও নিজেদের বক্তব্য প্রচারের কাজে। ফলে, টুইটারের বিরুদ্ধে সরকারের বিরাগের মূল কারণ নিহিত মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বিষয়ে সরকারের আন্তরিক অবস্থানের গভীরে।
সংবিধান-প্রদত্ত মতপ্রকাশের অধিকার বিষয়ে বিজেপি সরকারের মনোভাব কেমন, তার বহু উদাহরণ জেলখানায় মিলবে— সরকারবিরোধী মত পোষণ করেন, বা সত্য অনুসন্ধান করতে চান, নাগরিক সমাজের এমন বহু প্রতিনিধি ভারতে কারাবন্দি। সরকারের জনসংযোগ আধিকারিকে পর্যবসিত হননি, এমন বহু সাংবাদিকের বিরুদ্ধে আয়কর দফতর বা ইডি অভিযান করেছে। বিদেশি স্পাইওয়্যার কিনে আড়ি পাতা হয়েছে বিরোধী দলের নেতা বা নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের উপরে; ছক মেনে ধসিয়ে দেওয়া হয়েছে মুক্তচিন্তার পীঠস্থান বিশ্ববিদ্যালয়কে; উদার গণতান্ত্রিক মতবাদকে সমর্থন করে, এমন অ-সরকারি সংস্থার আর্থিক জোগান বন্ধ হয়েছে। কাজেই, নাগরিকের বাক্স্বাধীনতা খর্ব করার কাজে টুইটারের মতো সংস্থা যদি পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়ায়, তবে তাকে সরিয়ে দিতে সরকার সর্বশক্তি প্রয়োগে দ্বিধা করবে কি?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy