ভারত বলতে ঠিক কী বোঝায়, তার চমৎকার এক উপমা দিয়েছিলেন জওহরলাল নেহরু, তাঁর দ্য ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া গ্রন্থে। তিনি বলেছিলেন, ভারত এক পুঁথির মতো যেখানে স্তরে-স্তরে চিন্তা আর স্বপ্ন জমা হয়, কিন্তু কোনও স্তরই কখনও পুরোপুরি ঢাকা পড়ে যায় না, মুছেও যায় না। বারাসতের পার্থসারথি বসু ও তাঁর পরিবার গত কয়েক দশক ধরে যে ভাবে একটি মসজিদকে লালনপালন করছেন, তা এই বহু স্তরকে বাঁচিয়ে রাখারই ছবি। যে ভারতে সেই প্রাচীন যুগ থেকে ঋগ্বেদ বলে ‘সত্য একটিই’, সম্রাট অশোকের অনুশাসনে পরধর্মের নিন্দা করতে বারণ করা হয়, অজমেরের দরগায় মাথা ঠেকান যে কোনও ধর্মের মানুষ, সেই ভারতে হিন্দু পরিবারের হাতে মুসলমানদের উপাসনাস্থলকে বাঁচিয়ে রাখার কাজটি দেশের ঐতিহ্য ও ইতিহাসের কাছে বিরাট বড় সত্য। তা দেশের পক্ষে জরুরি দায়িত্ব ও কর্তব্যও বটে।
বস্তুত, এই সময়ে তার প্রয়োজনীয়তা আরও বেশি করে অনুভূত হয়। এই মুহূর্তে বারাণসীর জ্ঞানবাপী মসজিদ ও মথুরার শাহি ইদগা হয়ে দেশের প্রান্তে-প্রান্তে ভিনধর্মী সৌধগুলি মুছে ফেলার ডাক দিচ্ছে উগ্র দক্ষিণপন্থী শক্তিগুলি। সে ডাক সংগঠিত— শতসহস্র বছরের বহু স্তরের সঞ্চয়কে হিন্দুত্ববাদের একশিলায় ঢেকে দেওয়ার চেষ্টা। বহুত্ববাদী ভারতের বিপরীতে এই আখ্যান যে নাগপুরের পাঠশালায় জাত, তা বোঝাই যায়। এবং, শাসক দল তথা রাষ্ট্রক্ষমতার প্রকট ও প্রচ্ছন্ন অনুমোদনে সংখ্যাগুরুর এই বাড়াবাড়ি ক্রমশ স্বাভাবিক হয়ে উঠছে— সমাজতত্ত্বের ভাষায় ‘নর্মালাইজ়েশন’। তা ফুটে ওঠে কাশ্মীরের রাজনৈতিক নেতা মেহবুবা মুফতির কথাতেও, যখন তিনি বলেন যে, হিন্দুরা মসজিদ নিয়ে নিতে চাইলেও বাধা নেই, যদি তাতে হিংসা থামে। সংখ্যালঘুদের এমন ভয়-যন্ত্রণা নিয়ে বাঁচতে শেখাই— দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হয়ে থাকা— এখন ‘নিউ নর্মাল’। বসু পরিবার যথার্থ ভাবেই মসজিদ রক্ষণাবেক্ষণের কাজকে দেশসেবা বলে উল্লেখ করেন। নানা ধর্ম-সংস্কৃতির বিবিধতাই আমাদের দেশ, তাকে বাঁচিয়ে রাখাই দেশব্রত। এই মুহূর্তে যা পালন একান্ত প্রয়োজনীয়।
এখানে রাষ্ট্র ও সমাজের দুই ভিন্ন ভূমিকাও দেখা যায়। রাজনীতি যখন রাষ্ট্রকে কব্জা করে নিয়ে তার আদর্শ অনুসারে সমাজকে চালনা করার চেষ্টা করে, তখন বসু পরিবারের মতো সামাজিক উদ্যোগই তার প্রতিস্পর্ধা হতে পারে। এখানে রবীন্দ্রনাথের ‘স্বদেশী সমাজ’-এর ধারণাটি প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলতেন, ভারত পশ্চিমের মতো রাষ্ট্রনির্ভর সভ্যতা নয়, তা সমাজ-প্রধান সভ্যতা। অতএব, সমাজগঠনের কাজই এখানে দেশসেবা। সুতরাং, মিলেমিশে থাকার সুদীর্ঘ ঐতিহ্য যখন ভেঙে দেওয়া হচ্ছে রাষ্ট্রীয় মদতেই, তখন তার বিপরীতে সত্যিকারের ইতিহাসকে বাঁচিয়ে রাখতে পারেন সমাজের ভিতরে বাস করা নাগরিকেরা। ধর্মাচরণ, পোশাকআশাক, খাদ্যাভ্যাসের বহুত্ব নিয়ে ভারতীয় সমাজের আসল অস্তিত্ব এই ভাবেই সমাজের ভিতর থেকে বাঁচিয়ে রাখা যায়, যখন রাষ্ট্র সেই কাজে সহায় হয় না। বৈচিত্রময় উত্তরাধিকারের যে ‘আবিষ্কার’ দেশবাসী দেখেছিলেন নেহরুর চোখে, পার্থসারথি ও তাঁর পরিবার তারই বাহক ও সংরক্ষক। তাঁরা প্রকৃতই দেশব্রতী।
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy