— ফাইল চিত্র।
কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিম বলেছেন, অবৈধ নির্মাণ এক সামাজিক ব্যাধি। তিনি ভুল বলেছেন। অবৈধ নির্মাণ একটি রাজনৈতিক ব্যাধি। শাসক দলের ক্ষমতা ব্যবহার করে নির্মাণের বিধিনিয়ম হেলায় তুচ্ছ করা, দুর্বৃত্ত প্রোমোটারের হাতে এলাকার নিয়ন্ত্রণ তুলে দেওয়া, প্রাণঘাতী ও পরিবেশঘাতী কাজ অবাধে চলতে দেওয়া, এই সব কিছু সেই রাজনৈতিক ব্যাধির বহিঃপ্রকাশ। নেতাদের সীমাহীন লোভ, ক্ষমতা প্রদর্শনের নেশা আজ পশ্চিমবঙ্গের প্রধান অ-সুখ। সেই ব্যাধির ক্ষত ফুটে উঠেছে প্রতিটি পাড়ায়-মহল্লায়। কয়লা-গরু পাচার চক্র থেকে পুকুর ভরাট ও নির্মাণ সিন্ডিকেট, সবই সেই এক ব্যাধি-উদ্ভূত নানা পচা-গলা ঘা। অবৈধ নির্মাণ ধসে পড়ায়, নিরীহ নাগরিকের প্রাণহানিতে রাজনৈতিক মহল লজ্জিত হবে, ব্যাধির প্রতিকার খুঁজবে, সে আশাও দুরাশা। গার্ডেনরিচের সাম্প্রতিক কাণ্ডের পর দেখা গেল, মেয়র ঘটনার দায় সম্পূর্ণ পুরসভার ইঞ্জিনিয়ারদের উপর চাপালেন, তাঁদের শো-কজ় করলেন, অথচ স্থানীয় পুরপ্রতিনিধিদের সম্পূর্ণ মুক্তি দিলেন জবাবদিহির দায় থেকে। গার্ডেনরিচের স্থানীয় পুরপ্রতিনিধি শামস ইকবাল অবৈধ বাড়িটির ভেঙে পড়াকে ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ বলেছেন। দুটো চোখ এবং একটি মস্তিষ্ক যাদের আছে, তাদের পক্ষে এ কথা হজম করা বড়ই কঠিন। চোখের সামনেই পুকুর বুজিয়ে অবৈধ নির্মাণ তৈরি হতে, এবং নির্মাণের বিধি তুচ্ছ করে বাড়ির নির্মাণ দেখা যাচ্ছে কলকাতার অগুনতি ওয়র্ডে। এ ক’দিনে গার্ডেনরিচের যে ছবি সাংবাদিকরা ফের তুলে এনেছেন, তাতে আরও এক ধাপ এগিয়ে দেখা যাচ্ছে, বাড়ি ভেঙে পড়তে বাধ্য, তা জেনেই প্রোমোটাররা বাড়ি তৈরি করছেন ও বিক্রি করছেন। কারণ, জঞ্জাল দিয়ে ভরানো পুকুরের উপর যথেষ্ট মাটি না ফেলে, কেবল কোনও মতে একটা কাঠামো তৈরির মতো ব্যবস্থা করে, তাঁরা বাড়ি তৈরি করছেন। দু’টি বাড়ির মধ্যে দূরত্বের বিধির লঙ্ঘন, তিন-চারতলা বাড়ির ছাড়পত্র নিয়ে পাঁচ-ছ’তলা বাড়ি নির্মাণ, এ সবই অবাধে চলেছে। যে সব নির্মাণের বৈধতা পাওয়ার কোনও সম্ভাবনাই থাকার কথা নয়, সে সব বাড়িও বিক্রি হচ্ছে, বিদ্যুৎ এবং জলের সংযোগ পাচ্ছে।
এক কথায়, অনিয়মই যে গার্ডেনরিচে নির্মাণের নিয়ম হয়ে উঠেছে, সে বিষয়ে স্থানীয় বাসিন্দা এবং সাংবাদিকরা এক মত। সাংবাদিকরা বেশ কিছু তথ্য সামনে এনেছেন, যা থেকে ঘটনার নকশা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যেমন, গার্ডেনরিচের ১৫ নম্বর বরোর বেশ কয়েকটি অবৈধ বাড়ি ভাঙার প্রস্তাব পুরসভার ইঞ্জিনিয়াররা মেয়র পারিষদের বৈঠকে পেশ করেছেন। কিন্তু বিতর্কিত বাড়িটির উল্লেখ সেই তালিকায় নেই। সেই সঙ্গে এ-ও জানা গিয়েছে যে, ওই এলাকার প্রায় সব নির্মাণের পিছনেই ছিল বিশেষ এক জন প্রোমোটার। তাঁর অধীনের সাব-প্রোমোটারদের নামে নির্মাণের নথিভুক্তি হত কেবল। এতে রাজনৈতিক সংযোগের যে ইঙ্গিত মেলে, তাকে অগ্রাহ্য করে কী করে কেবল পুরকর্মীদেরই দোষী করা চলে? অবৈধ নির্মাণ ভাঙতে গিয়ে দুর্বৃত্ত প্রোমোটারদের হাতে বার বার লাঞ্ছিত হতে হয়েছে পুরকর্মীদের। ইঞ্জিনিয়াররা দায় এড়াতে পারেন না, কিন্তু কেবল তাঁদের ঘাড়ে দায় চাপানো একটি নিখাদ রাজনৈতিক কৌশল।
সামাজিক ব্যাধি মহানগরে কম নেই— আবর্জনা রাস্তায় ফেলা, জল জমিয়ে মশার বংশবৃদ্ধি, যত্রতত্র মূত্রত্যাগ, পিক ফেলা, এ সবই সামাজিক ব্যাধি। কিন্তু নির্মাণ সিন্ডিকেট সাধারণ মানুষকে সব দিক থেকেই বিপন্ন করে। খরচ বাড়ায়, বিপজ্জনক নির্মাণ তৈরি করে, আশেপাশের মানুষের প্রাণ বিপন্ন করে এবং সর্বোপরি, এলাকায় দুর্বৃত্ত-রাজ কায়েম করে। কলকাতার নানা অংশে যে এই দুর্বৃত্ত-রাজ অবাধে কাজ করে চলেছে, তার জন্য নিয়মিত প্রাণহানি হচ্ছে, অপচয় হচ্ছে নাগরিকের কষ্টার্জিত সম্পদের, মহানাগরিক তার দায় অস্বীকার করতে পারেন না। রাজ্যবাসীর চোখে মেয়র ফিরহাদ হাকিমও গার্ডেনরিচ কাণ্ডের জন্য দায়ী।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy