প্রতীকী ছবি।
ধর্ষক যদি ধর্ষিতাকে বিবাহ করিতে সম্মত হয়, তবে তাহার অপরাধটি মাফ হইয়া যাইবে— এহেন অবস্থানকে ভারতীয় সংবিধান স্বীকার করে কি না, সেই প্রশ্নটি বিশেষজ্ঞদের বিবেচনার জন্য তোলা থাকুক। কিন্তু এই অবস্থানটির পিছনে যে সম্ভাব্য পূর্বানুমানগুলি আছে, সেগুলিকে একে একে ভাঙিয়া দেখা যাইতে পারে। প্রথম পূর্বানুমান, ধর্ষণের একমাত্র ক্ষতি সংশ্লিষ্ট মহিলার ‘সতীত্বহানি’। বিশ্লেষণের স্বার্থেও কথাটি লিখিতে বিবমিষা হইতে পারে, কিন্তু নান্যঃ পন্থাঃ। ধর্ষণ নামক অপরাধটিকে সতীত্বহানি হিসাবে দেখিবার অর্থ ইহা ধরিয়া লওয়া যে, ঘটনাটি শুধুমাত্র একটি যৌনক্রিয়া, তাহার মধ্যে অধিকারভঙ্গ নাই, বলপ্রয়োগ নাই, বা অন্য কোনও অপরাধ নাই। যে কোনও নারীর শরীরই যে শুধুমাত্র এক জন পুরুষের— সেই মহিলার স্বামীর— ভোগ্য, এই কথাটিও এই অনুমানের মধ্যেই নিহিত। ফলে, ধর্ষক যদি ‘স্বামী’ হইতে সম্মত হয়, তবে সতীত্বহানির ঘটনাটিও বাতাসে মিলাইয়া যায়, অপরাধের আর অস্তিত্ব থাকে না। দ্বিতীয় পূর্বানুমান হইল, মহিলাদের কোনও ‘এজেন্সি’ নাই, ইচ্ছা-অনিচ্ছা নাই— কোনও নির্যাতিতার তাঁহার নির্যাতনকারীকে জীবনসঙ্গী হিসাবে গ্রহণ করিতে সুতীব্র আপত্তি বা ঘৃণা আছে কি না, সেই ভাবনাটির প্রয়োজনও নাই। মহিলা নামক সম্পত্তিটিকে তাঁহার ‘যৌন পবিত্রতা’র প্রিজ়মেই দেখা বিধেয়। সেই কারণেই, শুধুমাত্র সেই ‘পবিত্রতা’ পুনঃপ্রতিষ্ঠার ব্যবস্থাটুকু হইয়া গেলেই তাঁহার প্রতি কর্তব্যও সমাধা হইয়া যায়। ফলে, চোরের উপর ক্ষতিগ্রস্ত গৃহস্থের ভরণপোষণের দায় ন্যস্ত হয় না; খুনিকে বলা হয় না যে, সে নিহতের পরিবারের দেখভালের দায়িত্ব লইবে কি না— বস্তুত, এই কল্পনাগুলিই অলীক ঠেকে— কিন্তু, ধর্ষকের নিকট আদালত ধর্ষিতাকে বিবাহ করিয়া অপরাধের দায়মুক্ত হইবার প্রস্তাব করিতে পারে। পুরুষতন্ত্রের শিকড় উপড়াইবে, সাধ্য কাহার!
সমাজ যে বহুলাংশে এই পথেই ভাবে, তাহা অস্বীকার করিবার উপায় নাই। এখনও ধর্ষণের লজ্জা বহন করিতে হয় ধর্ষিতাকেই। ধর্ষকের পার্শ্বে আসিয়া দাঁড়ান রাজনৈতিক প্রভাবশালীরা, তাহাকে লইয়া পথে বিজয়মিছিল করেন। বস্তুত, ভারতের রাজনীতি স্বেচ্ছায় ও সোল্লাসে পুরুষতন্ত্রের ধ্বজা বহিয়া চলিতেছে। উত্তরপ্রদেশে যে ‘লাভ জেহাদ’ নিবারণী আইন চালু হইয়াছে, তাহার মূল কথাটিই হইল যে, নারী সম্পত্তিমাত্র— এবং, সেই সম্পত্তিকে রক্ষার ভার সমাজের উপর ন্যস্ত। রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের নিকট ন্যায়বিচারের প্রত্যাশা ভারতবাসী বহু যন্ত্রণায় ত্যাগ করিয়াছে। যে প্রতিষ্ঠানটির উপর মানুষের শেষ ভরসা, তাহা বিচারবিভাগ। অস্বীকার করিবার উপায় নাই যে, বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নিম্নতর আদালত ধর্ষক ও ধর্ষিতার বিবাহের বন্দোবস্ত করিয়াছে। কিন্তু, দেশের সর্বোচ্চ আদালতে, প্রধান বিচারপতির এজলাসেও যদি একই কথা শুনিতে হয়, তবে তাহা অতি দুশ্চিন্তার বিষয়। আদালতের প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা বজায় রাখিয়াও প্রশ্ন করিতে হয়, ইহাই কি ন্যায্য বিচার? ধর্ষণের অভিযোগে গ্রেফতার হইলে সরকারি চাকুরের চাকুরি যাইতে পারে, ইহা সেই অপরাধীর প্রতি সহানুভূতিশীল হইবার কারণ হইতে পারে কি? বিশেষত, শুধু ধর্ষণ নহে, এই ক্ষেত্রে মামলা পকসো আইনে— অর্থাৎ, অভিযুক্তের বিরুদ্ধে নাবালিকার যৌন নিগ্রহ করিবার অভিযোগ। এহেন অভিযুক্তের প্রতি কি কোনও কারণেই সহানুভূতিশীল হওয়া চলে? সুপ্রিম কোর্ট, এমনকি প্রধান বিচারপতির কণ্ঠস্বরেও যদি পুরুষতন্ত্রের অনুরণনের অভ্রান্ত ইঙ্গিত মিলিতে থাকে, তবে আদালতের নিকট আত্মবিশ্লেষণের সবিনয় প্রার্থনা করাই বিধেয়। নারী যে কেবল যৌনসামগ্রী নহে, তাহার সমগ্র অস্তিত্বকে কোনও কারণেই শুধু ‘যৌন পবিত্রতা’ থাকা বা না থাকায় সীমিত করিয়া ফেলা যায় না, ভারতের শীর্ষ আদালতও এই কথাটি দ্ব্যর্থহীন ভাবে বলিবে না?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy