—প্রতীকী ছবি।
পশ্চিমবঙ্গের এ বারের পঞ্চায়েত ভোটের আগে থেকেই একটি বিষয় বড় মাপের আলোচ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে: তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সম্পর্ক এখন কেমন। এ রাজ্যের মুসলমানরা কি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতি তাঁদের সমর্থন থেকে সরে আসছেন? সংশয়টি নতুন নয়, তবে জল্পনা-কল্পনা প্রবল জোরদার হয়ে উঠেছে গত ফেব্রুয়ারিতে মুর্শিদাবাদের জঙ্গিপুরে সাগরদিঘির উপনির্বাচনের পর থেকে। যদিও সেই উপনির্বাচনে তৃণমূল প্রার্থীকে অনেক ব্যবধানে পরাজিত করেও জয়ী কংগ্রেস প্রার্থী পরবর্তী কালে তৃণমূলের ঘাটেই তরী ভিড়িয়েছেন, কিন্তু সে সব হিসাবনিকাশের স্বার্থগন্ধময় রাজনীতির পরিচিত কাহিনি, তাতে মাটির বাস্তব বদলে যায় না। যদিও এক দীর্ঘ সময় এ রাজ্যে মুসলমান সমাজ কোনও ভোট-ব্লক হিসাবে বিরাজ করত না, সেই বাস্তব ধীরে ধীরে বাম আমলের শেষ দিকেই পাল্টিয়েছিল। ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে ঐতিহাসিক ‘পরিবর্তন’-এ সংখ্যালঘুর ভোট একটি বড় নির্ণায়ক ভূমিকা পালন করেছিল। তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় আসা ইস্তক সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের দিকে তাকিয়ে নীতি প্রণয়ন এবং স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীর বিবিধ ‘মুসলমান-মনস্ক’ রাজনীতি-প্রকরণ এত দিন মুসলমান সম্প্রদায়কে সমর্থক হিসাবে পাশে পেতে বিশেষ ভাবে কাজে লেগেছে। সেই বাস্তব কি পাল্টাচ্ছে? পাল্টালে, কোথায় এবং কতখানি? এ সব বুঝতে ২০২৩ সালের পঞ্চায়েত ভোট বিশেষ সহায়তা করবে, এমন আশা করাই যায়।
প্রসঙ্গত, ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত ভোট যে স্বতঃস্ফূর্ত ও গণতান্ত্রিক ছিল না, শাসক নেতারাও আজ তা অস্বীকার করেন না। ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে যে বিজেপির হিন্দুত্ব রাজনীতির আগ্রাসন-আতঙ্ক, এবং নাগরিকত্ব আইন সংশোধনীর আশঙ্কা মুসলমানদের রাজ্য জুড়ে তৃণমূলের দিকে ঠেলে দিয়েছিল, তাতেও সন্দেহ নেই। গত কয়েক বছর ধরে নানা কারণেই মুসলমান সম্প্রদায়ের প্রতি তৃণমূল সরকারের পূর্বতন বদান্যতারও কিছু পরিবর্তন ঘটেছে। সম্প্রতি সরকারি প্রযত্নে নরম হিন্দুত্বের আরাধনাও দেখা গেছে। মুসলমান-সমর্থন অটুট থাকা না-থাকার উপরে তৃণমূলের দলশক্তির পরিমাণ বিপুল ভাবে নির্ভরশীল। সুতরাং, এই পঞ্চায়েত ভোটের ফলাফল রাজ্যের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে একটি জরুরি দিকনির্দেশ হয়ে দাঁড়াতেই পারে।
লক্ষণীয়, গত বিধানসভা নির্বাচনের পর অনেক ক্ষেত্রেই ঘটনা এগিয়েছে দ্রুতগতিতে। দুর্নীতির যে সমুদ্রে সরকারি নেতাকর্তারা রাজ্যকে ভাসিয়ে দিয়েছেন বলে জনমানসে প্রতিষ্ঠিত, সে কেবল শাসক সমাজের অনৈতিকতা ও অকর্মণ্যতার পরিচয় নয়। বিষয়টির মধ্যে রাজ্যবাসীর সামাজিক-অর্থনৈতিক স্বার্থের সমূহ ক্ষতি ইতিমধ্যেই সাধিত, বিশেষ করে শহরতলি ও গ্রামগঞ্জের এক বিরাট সংখ্যক পরিবার এই দুর্নীতিতে প্রত্যক্ষ ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত, চাকরি থেকে শিক্ষা, অধিকারহীনতার ক্ষতে জর্জরিত। পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান সমাজকে যে-হেতু কেবল সংখ্যালঘু বলে আলাদা কুঠুরিতে রেখে বিবেচনা করলে চলবে না, তাঁরা এই রাজ্যেরই হতাশ্বাস নাগরিক সমাজের একটি বড় ও গুরুত্বপূর্ণ অংশ— এই ক্ষতিগ্রস্ত বিপন্ন বৃহত্তর নাগরিকদের মধ্যে তাঁরাও পড়েন। তা ছাড়া, সাচার-পরবর্তী পশ্চিমবঙ্গে সংখ্যালঘু সমাজের উন্নয়নকল্পে যে সব প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল, তার কয়েকটি আপাতত নামমাত্র এবং অকেজো হয়ে পড়ে আছে, বিশেষত উচ্চশিক্ষার্থে ঋণদান ইত্যাদি। অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণিপরিচয় সম্বলিত সার্টিফিকেট যে সংখ্যালঘুদের জন্য ঘোষিত, অনেকেই এখনও তা পাননি, এমনকি ‘দুয়ারে সরকার’-এর পরও। প্রধান বিরোধী দল বিজেপি যথারীতি ধর্মীয় বিভাজন ঘটিয়ে রাজনৈতিক ফল তুলতে ব্যস্ত, বাম ও কংগ্রেস দলগুলিও সংখ্যালঘু সমাজে হৃত জমি উদ্ধার করতে উদ্গ্রীব। এই পরিস্থিতিতে বর্তমান শাসকরা এখনও কিছুমাত্র আশা জোগাতে পারছেন কি না, সংখ্যালঘু মানুষই তা প্রমাণ করবেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy