তাদের কোনও রাজনৈতিক রং নেই, বিশেষ সিবিআই আদালতে দাঁড়িয়ে জানাল ইডি। ফাইল ছবি।
তাদের কোনও রাজনৈতিক রং নেই, বিশেষ সিবিআই আদালতে দাঁড়িয়ে জানাল ইডি। মুখের কথা নয়, একেবারে ভগবদ্গীতার শ্লোক উদ্ধার করে ইডি-র প্রতিনিধি জানিয়েছেন, কর্মেই তাঁদের অধিকার, ফলে নয়। দুর্জনে বলতে পারে, কথাটি তিনি মিথ্যা বলেননি— ইডি, আয়কর দফতর বা সিবিআই-এর মতো প্রতিষ্ঠানকে রাজনৈতিক ভাবে ব্যবহার করা হলে তার সুফল তো আর দফতর পায় না, ব্যবহারকারীরাই পান। কিন্তু, দুর্জনের কথা থাক। ভারতবাসী বরং নিজেদের অসীম দুর্ভাগ্যের কথা ভাবতে পারে— দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আইনরক্ষক প্রতিষ্ঠানকে আদালতে দাঁড়িয়ে নিজেদের নিরপেক্ষতার দাবি করতে হচ্ছে! প্রতিষ্ঠানের বিশ্বাসযোগ্যতা কতখানি কমলে এই পরিণতি হতে পারে, তা ভেবে সুতীব্র লজ্জা বোধ হয়। আপাতদৃষ্টিতে দাবিটি অন্তঃসারশূন্যও বটে। শুধু ইডি নয়, কয়েক বছরে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাগুলির তদন্তের অভিমুখ যে ভাবে মূলত বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতা, কেন্দ্রীয় সরকারের অকুণ্ঠ প্রশস্তিতে নারাজ সাংবাদিক বা নাগরিক সমাজের প্রশ্নশীল অংশের দিকে থেকেছে, তাতে কারও মনে হতেই পারে যে, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা নয়, সংস্থাগুলির প্রধান উদ্দেশ্য হয়তো রাজনৈতিক প্রতিহিংসা। মনে হতেই পারে যে, সংস্থাগুলি ক্ষমতাসীন দলের হয়ে বিরোধী কণ্ঠস্বর দমনের কাজ করছে। পূর্ববর্তী জমানায় এক বিচারপতি সিবিআই-কে খাঁচার তোতা বলে কটাক্ষ করেছিলেন। সেই খাঁচায় বন্দি টিয়ার সংখ্যা বেড়েছে তো বটেই, কারও মনে হতেই পারে যে, ইদানীং আর খাঁচারও প্রয়োজন পড়ছে না— টিয়াগুলি স্বেচ্ছাবন্দি।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলবেন, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের মেরুদণ্ড ভেঙে ফেলা বর্তমান শাসনের অভিজ্ঞান। প্রতিষ্ঠানগুলির শীর্ষে রয়েছেন যাঁরা, তাঁদের রাজনৈতিক আনুগত্য গোপন থাকেনি। কেউ বলতেই পারেন যে, শুধু তদন্তকারী সংস্থাই নয়, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক পরিসরের কার্যত প্রতিটি প্রতিষ্ঠানই বর্তমানে আনুগত্যের যুক্তিতে পরিচালিত হয়। রাজনৈতিক বিশ্লেষক ক্রিস্তাফ জাফ্রেলো প্রতিষ্ঠানকে দখল করার এই প্রক্রিয়াটিকে হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বৃহত্তর প্রকল্পের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য বলে দাবি করেছিলেন। স্বল্প বা মাঝারি মেয়াদে বিরুদ্ধ স্বর দমনের কাজে ব্যবহৃত হবে প্রতিষ্ঠানগুলি; কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে তা পরিচালিত হবে এক নির্দিষ্ট রাজনৈতিক ধারণাসঞ্জাত আধিপত্যবাদের যুক্তিতে, এবং তার শাসনের পরিসরে অন্য কোনও যুক্তির, ধারণার বা দাবির বৈধতা থাকবে না। রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিসরে এমন হেজেমনির গুরুত্ব বিপুল।
উগ্র হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক প্রকল্পের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক আধিপত্য জরুরি, কিন্তু ভারতীয় গণতন্ত্রের পক্ষে তা মারাত্মক। তার প্রধানতম কারণ, ভারত নামক ধারণাটির মূল চালিকাশক্তি সর্বজনীন, গ্রহণশীল, উদারবাদী ধর্মনিরপেক্ষতা। রাষ্ট্রীয় স্তরে সেই চালিকাশক্তি শুধুমাত্র রাজনৈতিক কল্পনার অন্তর্গত হওয়াই যথেষ্ট নয়, প্রশাসনিক স্তরগুলিতেও তা সমান ভাবে প্রসারিত হওয়া জরুরি। বিভিন্ন স্তরে, বিভিন্ন ক্ষমতায় যাঁরা প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড নির্বাহ করেন, তাঁরা যদি প্রকৃত উদারবাদে বিশ্বাসী না হন, তবে হাজার রাজনৈতিক সদিচ্ছাও ভারতের ধারণটিকে রক্ষা করতে পারবে না। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বা তাঁর রাজনৈতিক জয়রথটিকে আজ যাঁর যতখানিই অদম্য বোধ হোক না কেন, বৈশ্বিক ইতিহাস সাক্ষী যে, কোনও শাসকের দাপটই চিরস্থায়ী হয়নি। কাল না হোক পরশুর পরের দিন ভারতেও শাসক পাল্টাবেই। কিন্তু, প্রশাসনের মজ্জায় যদি ধর্মনিরপেক্ষতার পরিবর্তে সংখ্যাগুরুবাদের মন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়, তাতে বারংবার খর্ব হবে ভারতের আত্মা। অতএব, সব রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের নিরপেক্ষতা বিষয়ে প্রতিটি নাগরিকের ঘোর দুশ্চিন্তার কারণ রয়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy