আরও এক বার ‘ডবল ইঞ্জিন’-এর তত্ত্ব শুনাইয়াছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। কেন্দ্রে ও রাজ্যে একই দলের সরকার থাকিলে তাহারা পরস্পরের সহিত সহযোগিতা করিবে, এবং উন্নয়নের মহাসড়কে রাজ্য দ্রুত অগ্রসর হইবে, ইহাই এই তত্ত্বের মূল প্রতিপাদ্য। প্রধানমন্ত্রীর তত্ত্বের দার্শনিক সারবত্তা বিচারের পূর্বে তাহার ফলিত প্রয়োগটি দেখা বিধেয়। একটি উদাহরণই যথেষ্ট— উত্তরপ্রদেশ। সে রাজ্যে গত চার বৎসর যাবৎ বিজেপির শাসন। কেন্দ্রেও বিজেপির সরকার। কিন্তু, উন্নয়নের মাপকাঠিতে রাজ্য অগ্রসর হইয়াছে, এমন কথা বলিবার উপায়মাত্র নাই। শিক্ষা বা স্বাস্থ্যে পরিস্থিতির উন্নতি হয় নাই; কর্মসংস্থানেও নহে, পরিকাঠামোতেও নহে। নারীর সুরক্ষা বা ক্ষমতায়নের প্রশ্নটি তো না তোলাই ভাল। কেন্দ্র হইতে রাজ্যের উন্নয়নে কোনও বড় অর্থবরাদ্দও হয় নাই। ত্রিপুরা হইতে মধ্যপ্রদেশ, সর্বত্রই একই পরিস্থিতি। বিজেপি-শাসিত যে রাজ্যগুলি অন্তত অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের নিরিখে দেশে অগ্রগণ্য, সেই গুজরাত বা কর্নাটকের উন্নতি কেন্দ্রে বিজেপির সরকার আছে কি না, তাহার উপর নির্ভরশীল নহে। যখন কেন্দ্রে ইউপিএ সরকার ছিল, সেই আমলেই গুজরাতের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ‘গুজরাত মডেল’ রূপায়ণ করিয়াছিলেন। অর্থশাস্ত্রীরা বলিবেন, কোন দলের সরকার কোথায় ক্ষমতাসীন, রাজ্যের উন্নয়নের ক্ষেত্রে তাহার তুলনায় ঢের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে। সেই আলোচনা অন্যত্র, কিন্তু এইটুকু বলিয়া রাখা জরুরি যে, পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির সরকার আসিলেই এই রাজ্যে উন্নয়নের রথ জোড়া ইঞ্জিনে দৌড়াইবে, এহেন দাবির কোনও ভিত্তি নাই— উহা ‘জুমলা’মাত্র।
কিন্তু, নির্বাচনী অনৃতভাষণই এই ক্ষেত্রে সর্বাধিক আপত্তিজনক বিষয় নহে। কেন্দ্র ও রাজ্যে ভিন্ন দলের সরকার থাকিলে উন্নয়নের পথে যে সকল বাধার সৃষ্টি হয়, তাহার সমস্তটাই যে অনিবার্য নহে, প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে এই ইঙ্গিতটি স্পষ্ট। অর্থাৎ, ভিন্দলের সরকারের হাত বাঁধিয়া রাখিতে উন্নয়নে অসহযোগিতা একটি অস্ত্র, প্রধানমন্ত্রী কার্যত তাহা স্বীকার করিয়া লইলেন। দেশের বহুস্তরীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো যে বিশ্বাসের ভিত্তিতে টিকিয়া থাকে— যে বিশ্বাস এই কাঠামোটিকে কার্যকর ও জনহিতৈষী করিয়া রাখে— প্রধানমন্ত্রীর ইঙ্গিতটি সরাসরি সেই বিশ্বাসের মূলেই আঘাত করিতেছে। রাজ্যে যে দলেরই সরকার থাকুক না কেন, উন্নয়নের ক্ষেত্রে তাহাকে সর্বতো সহযোগিতা করাই কেন্দ্রীয় সরকারের কর্তব্য। এই দায় কোনও রাজনৈতিক দলের নিকট নহে— এই দায় দেশের সংবিধানের প্রতি, দেশের নাগরিকের প্রতি। কেন্দ্রীয় সরকার যদি রাজনৈতিক রং বাছিয়া উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় সাহায্য করে, বা বাধা সৃষ্টি করে, তবে তাহা দেশের নাগরিকের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা।
‘কেন্দ্রীয় বঞ্চনা’র এই অস্ত্রটি নরেন্দ্র মোদীর আবিষ্কার নহে— বস্তুত, কেন্দ্রে কংগ্রেস সরকারের বিরুদ্ধে পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থী শাসকদের প্রধানতম অভিযোগ ছিল এই বঞ্চনারই। রাজ্যের অভ্যন্তরীণ অভিজ্ঞতাও বলিবে যে, বিরোধীদের দখলে থাকা পঞ্চায়েতে টাকা পৌঁছাইতে অনেক বেশি সময় লাগে, অজ্ঞাত কারণে প্রকল্প আটকাইয়া থাকে। কিন্তু, ইতিপূর্বে কোনও কেন্দ্রীয় শাসক স্বীকার করেন নাই যে, তাঁহারা সত্যই বিরোধীশাসিত রাজ্যগুলির সহিত বিমাতৃসুলভ আচরণ করেন। কেহ বলিতে পারেন, পূর্বসূরিদের তুলনায় নরেন্দ্র মোদী সৎ। অন্য কেহ অবশ্য ইহাও বলিতে পারেন যে, আর পাঁচটি জিনিসের ন্যায় এই ক্ষেত্রেও তিনি রাজনৈতিক ক্ষুদ্রতাকে গোপন করিবার চেষ্টা করেন নাই। বরং আশা করিয়াছেন, এই ক্ষুদ্রতাই তাঁহাদের আরও জনপ্রিয় করিবে। তাহাতে ভারত নামক দেশটির সত্তা যদি রক্তাক্ত হয়, তাহাতেও ক্ষতি নাই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy