ফাইল চিত্র।
অতিমারি হইতে দেশকে বাঁচাইতে হইবে সরকারকে। হাসপাতাল শয্যা, অক্সিজেন ইত্যাদির ব্যবস্থা করিলে মানুষের প্রাণ বাঁচিবে। কিন্তু শিক্ষা? জাতিকে বাঁচাইতে হইলে শিক্ষাকে বাঁচাইতে হইবে। এই রাজ্যে স্কুলশিক্ষার অবস্থা উদ্বেগজনক। এক বৎসর প্রাথমিক স্কুলগুলি মিড-ডে মিলের চাল-আলু বিলি করিবার জন্য দরজা খুলিয়াছে, ছাত্রছাত্রীদের জন্য নহে। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার দিন ঠিক হইয়াছে, মাধ্যমিক পরীক্ষা বিষয়ে ঘোষণা হয় নাই। অর্থাৎ, রাজ্যে স্কুলশিক্ষা তাহার অভ্যস্ত ছন্দ হইতে বিচ্যুত হইয়াছে। কবে পুনরায় দৈনন্দিন পঠনপাঠনের কর্মসূচিতে ফিরিবে, তাহা স্পষ্ট নহে। চিত্রটি উদ্বেগজনক। বহু বৎসরে, বহু আন্দোলনে ‘সর্বশিক্ষা’র যে আদর্শকে বাস্তবে রূপায়িত করা সম্ভব হইয়াছিল, এক বৎসরের মধ্যে তাহা আবার পূর্বের ন্যায় ‘অধিকারভেদ’-এর ধারণায় পর্যবসিত হইয়াছে। যাহার স্মার্টফোন রহিয়াছে, ইন্টারনেট সংযোগের টাকা গনিবার ক্ষমতা রহিয়াছে, সর্বোপরি ইন্টারনেট-সংযুক্ত এলাকায় যে শিশুর বাস, তাহারই আজ শিক্ষার অধিকার রহিয়াছে। ইন্টারনেট সিগন্যালের দুর্বলতা এখন শিক্ষার দুর্বলতা হইয়া দেখা দিয়াছে। ডিজিটাল সুবিধায় তারতম্যের জন্য গ্রাম ও শহর, সরকারি বিদ্যালয় ও বেসরকারি বিদ্যালয়ের বৈষম্য প্রকট হইয়াছে, এমনকি একই স্কুলের সহপাঠীদের শিক্ষালাভে হেরফের হইতেছে। সমাজ বৈষম্যহীন নহে, কিন্তু শিক্ষার সমতা তাহাকে পরাভূত করিবে, এই প্রত্যাশা হইতেই শিক্ষার অধিকার আইন রূপায়িত হইয়াছে। আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা পরিকল্পিত হইয়াছে। ‘শিক্ষার মাধ্যমে সাম্য’— এই আদর্শ হইতে যদি অতিমারি ভারতকে বিচ্যুত করে, তাহার ফল হইবে সুদূরপ্রসারী। শৈশবে শিক্ষালাভের সুযোগের কাঠামোগত বৈষম্য বহু ছেলেমেয়ের জীবন-কক্ষপথটিকেই সম্পূর্ণ বদলাইয়া দিবে। ক্রমবর্ধমান অসাম্য তাহাতে আরও বেগবান হইয়া উঠিবে।
শিক্ষার এই সঙ্কট অনুমান করিয়া নানা পদক্ষেপ করিয়াছে নানা রাজ্য। পশ্চিমবঙ্গ সরকার ‘ট্যাব’ কিনিবার জন্য অনুদান দিয়াছে। আক্ষেপ, তাহা মিলিতেছে দ্বাদশ শ্রেণিতে। স্কুলশিক্ষার প্রায় সবটাই তত দিনে অতিবাহিত। কেরলে রাজ্য সরকার কিছু টিভি চ্যানেল স্কুলের ক্লাসগুলির জন্য নির্দিষ্ট করিয়াছে। কোথাও শিক্ষকরা উদ্যোগী হইয়া কমিউনিটি রেডিয়ো ব্যবহার করিতেছেন। যাহারা অনলাইন ক্লাসে যোগ দিতে পারে নাই, সেই ছাত্রদের ক্লাসের ‘রেকর্ডিং’ পাঠাইয়া দিতেছেন। অনেক স্কুলের শিক্ষকরা স্বতঃপ্রণোদিত হইয়া গরমের ছুটিতেও অনলাইন পঠনপাঠন চালু রাখিয়াছেন। তাঁহাদের এই সকল উদ্যোগ প্রশংসনীয়, কিন্তু এমন স্বেচ্ছা-উদ্যোগ আজ যথেষ্ট নহে। এত দিনে স্পষ্ট হইয়াছে যে, অতিমারি সহজে মিলাইয়া যাইবে না। তাহা বার বার আসিতে পারে, ধরিয়াই পরিকল্পনা করিতে হইবে। শিক্ষায় ডিজিটাল বিভাজন দূর করিতে রাজ্যকে উদ্যোগ লইতে হইবে।
প্রশ্ন উঠিবে, টাকা কোথায়? উত্তরে স্মরণ করিতে হইবে সেই বিখ্যাত উক্তিটি, “যদি শিক্ষার মূল্য লইয়া চিন্তিত হও, তবে অশিক্ষার কী মূল্য দিতে হইবে চিন্তা করো।” স্কুলশিক্ষাকে সার্বিক করিতে ডিজিটাল মাধ্যমের সম্প্রসারণে ব্যয় করিতে হইবে সরকারকে, তাহাকে মানবসম্পদে বিনিয়োগ বলিয়া দেখিতে হইবে। প্রয়োজনে অপরাপর ব্যয় সঙ্কোচ করিতে হইবে, কিন্তু শিক্ষার সঙ্কোচ হইতে দেওয়া চলিবে না। শিক্ষার ফাঁক ঢাকিতে পরীক্ষার নামে প্রহসন এবং ঢালাও নম্বর বিতরণের যে কুনাট্য শুরু হইয়াছে, তাহাও বন্ধ করিতে হইবে। প্রাথমিকের শিক্ষা সম্পূর্ণ করিবার পূর্বে শিশুর লিখিতে-পড়িতে, অঙ্ক কষিতে পারিবার দক্ষতা নিশ্চিত করিতে হইবে। শ্রেণি-উপযোগী শিক্ষালাভ নিশ্চিত করিয়া তবেই তাহার স্কুলশিক্ষা সম্পূর্ণ হইবে। শিক্ষা খাতে বরাদ্দ ও খরচ দেখাইবার নাম ‘শিক্ষা’ নহে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy