প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
বিদ্যালয়ের লেখাপড়াকে সত্যিই আনন্দপাঠ করে তোলা গেলে তত দুশ্চিন্তা থাকত না। সে জন্য গোড়ার যে কাজটা হওয়া দরকার তা হল নিয়ম করে ক্লাস হওয়া, ছাত্রছাত্রীদের উপস্থিতি নিশ্চিত করা। তার বদলে পশ্চিমবঙ্গের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলি দেখল, কোভিড কেড়ে নিয়েছে লেখাপড়ার দু’-দুটো বছর, শিশুদের পড়ার অভ্যাসটাই ‘অতীত’। গত বছর ফেব্রুয়ারিতে স্কুল খোলার পর ফুটে উঠেছিল করুণ বাস্তব: একে তো বহু ছেলেমেয়ে স্কুলছুট, আর যারা আসছে, তারাও পুরনো পড়া গিয়েছে ভুলে— অঙ্ক করতে পারছে না, চেনা পাঠ্যবই থেকে পড়তে দিলেও হোঁচট খাচ্ছে, সহজ সাধারণ শব্দ দিয়ে বাক্য গঠনেও সমস্যা হচ্ছে তাদের। তার পর এক বছর গড়িয়ে গেছে, এ বছর প্রচণ্ড গরমে গ্রীষ্মাবকাশ হয়েছে দীর্ঘতর, দেড় মাস পর স্কুলে এসে দেখা যাচ্ছে শিক্ষার্থীদের সঙ্কট কাটেনি। এই পরিপ্রেক্ষিতেই প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের উদ্যোগে সরকারি, সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত ও সরকার-পোষিত প্রাথমিক স্কুলগুলিতে শুরু হয়েছে ‘পঠন উৎসব’— শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের নিয়ে।
উৎসব বললেই পশ্চিমবঙ্গের জনমানসে ইদানীং যত না আনন্দ তারও বেশি শঙ্কা ঘনায়, দরকারি কাজগুলি ভুলে থেকে বা মানুষকে তা ভুলিয়ে রেখে ছুটি আর আনন্দ-ফুর্তিতে সরকারের আগ্রহ যে শঙ্কার কারণ। দেড় মাস লম্বা গরমের ছুটির পর প্রাথমিক স্কুলে হঠাৎ ‘পঠন উৎসব’-এর আয়োজনেও একই শঙ্কার কারণ ছিল, তবে এখনও পর্যন্ত স্কুলে স্কুলে ছবিটি ইতিবাচক: নানা রকম ‘বর্ণ কার্ড’, চার্ট, মডেল ইত্যাদি তৈরি করে শিক্ষক-শিক্ষিকারা শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় খামতি বোঝার চেষ্টা করছেন, বহুবিধ বিকল্প পদ্ধতিতে ছাত্রছাত্রীদের যাচাই করছেন কিন্তু শিশুদের তা ‘পরীক্ষা’ বলে মনে হচ্ছে না, তারাও সোৎসাহে উত্তর দিচ্ছে বা প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে। এই সবই আশা জোগায়, কারণ প্রাথমিক শিক্ষা আগাগোড়া এমনই হওয়ার ছিল। আর্থ-সামাজিক অবস্থান নির্বিশেষে শিশুদের স্কুলে আসা নিশ্চিত করাটা যদি গোড়ার কথা হয়, তার পরের গুরুত্বপূর্ণ কাজই হল প্রাথমিক স্তর থেকে পড়াশোনাকে আনন্দপাঠ করে তোলা, স্রেফ মিড-ডে মিল পাওয়ার ক্ষেত্র নয়। শিক্ষকেরা ছেলেমেয়েদের সঙ্গে আন্তরিক ভাবে কথা বলছেন, ছুটিতে তারা কে কী করেছে বা করেনি তা শুনছেন মন দিয়ে, ‘উৎসব’-এর আবহে বুঝে নিচ্ছেন কোন পড়ুয়া কতটা পিছিয়ে আছে, ফলাফল বিশ্লেষণ করে পরবর্তী পদক্ষেপ করছেন— এই সব কিছুই আসলে হওয়া দরকার বছরভর। পঠন উৎসবে যদি সেই কাজের শুভারম্ভ হয় তবে তা স্বাগত।
একই সঙ্গে মনে রাখা দরকার, কোভিডের পাশাপাশি প্রাথমিক শিক্ষাকে ধাক্কা দিয়েছে শিক্ষক নিয়োগ সংক্রান্ত বিরাট দুর্নীতি। মনে রাখা দরকার, গত দশ বছরে রাজ্যে বন্ধ হয়ে গিয়েছে সাত হাজারেরও বেশি প্রাথমিক স্কুল; জানা দরকার, শিক্ষার অধিকার অনুযায়ী প্রাথমিক স্কুলে শিক্ষক-শিক্ষার্থী কাঙ্ক্ষিত অনুপাত ১:৩০, এ রাজ্যে যা ১:৭৩। সর্বোপরি, প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষৎ, রাজ্য শিক্ষা দফতর ও সরকারের বোঝা দরকার, ধাক্কাটা অতিমারি, দাবদাহেরই হোক বা দুর্নীতির, সুদূরপ্রসারী ক্ষতি হয় কোমলমতি শিক্ষার্থীদের; বনিয়াদি স্তরে পড়াশোনা না হলে মুছে যায় উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। তাই পঠন উৎসব সহায়েই হোক বা রোজকার রুটিনেই, ফেরানো দরকার সারবস্তুটি— প্রাথমিকে পড়াশোনার সংস্কৃতি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy