চুঁচুড়ায় অস্ত্র নিয়ে রামনবমীর মিছিল। ছবি: তাপস ঘোষ। নিজস্ব চিত্র।
অত্যন্ত গুরুতর বিষয় নিয়ে যখন ছেলেখেলা হয়, এবং সেই ছেলেখেলার দায় যখন বর্তায় রাজ্যের প্রশাসনের উপরে, তখন নাগরিকের কী করার থাকে, কী-ই বা ভাবার থাকে— এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন এটাই। গত কয়েক দিন যাবৎ রামনবমীকে কেন্দ্র করে যে তরজা সংঘটিত হচ্ছে, তার মধ্যে বিবিধ রাজনৈতিক চাল ও চাতুর্যের সঙ্গে আছে— নাগরিক সমাজের ‘নির্বুদ্ধিতা’র প্রতি বিরাট এক ‘ভরসা’। প্রশাসকরা ধরেই নিয়েছেন যে, নির্বোধ নাগরিককে বোঝানো যাবে, যা বোঝাবার। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সরাসরি এই কথাটি বলার সময় এসেছে যে, ঘটনার চরিত্র এবং পরম্পরা দেখে ঘটনার নেপথ্যভূমি সম্পর্কে ধারণা করার ক্ষমতা এই রাজ্যের মানুষের আছে। অতি অবাঞ্ছিত অশান্তি দিনের পর দিন ঘটতে দেওয়ার পিছনে প্রশাসনের বড় রকমের দায়িত্বস্খলন দিনের আলোর মতো স্পষ্ট। প্রথমেই এই অশান্তি বন্ধ করা যেত, এবং পরবর্তী অশান্তি তো বন্ধ করা যেতই। রামনবমী উপলক্ষে ঠিক কী ধরনের অশান্তি হতে পারে, পশ্চিমবঙ্গবাসী মাত্রেই তা এখন জানেন— কেবল রাজ্য প্রশাসনই কি স্বপ্নালু আশাময়তায় বিভোর ছিল, ভেবেছিল কেবল ভক্তিভাবের তরঙ্গ বইবে মিছিলের কূলে-উপকূলে? পর পর পাঁচ দিন সঙ্কট অব্যাহত থাকার পর এখন মুখ্যমন্ত্রী বুলডোজ়ারের কথা তুলে মানুষকে বোঝাতে চাইছেন, তিনি এবং তাঁরা সতর্ক থাকা সত্ত্বেও বুলডোজ়াররা কে জানে কী করে অনর্থ বাধিয়েছে?
দুই দশক আগে এক ঐতিহাসিক সঙ্কটক্ষণে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী গুজরাতের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে রাজধর্ম পালন করার ঐতিহাসিক উপদেশ দিয়েছিলেন। ভয়ঙ্কর সেই দিন যখন, রাজধর্মবিচ্যুতির ভাগীদার হন সব দলের সব নেতানেত্রী। নিজেরা রাজধর্ম পালন না করে তাঁরা মানুষকে ঠেলে দিচ্ছেন অবর্ণনীয় বিপর্যয় ও সঙ্কটের দিকে। এবং ভয়ঙ্করতর সেই দিন, যখন তাঁরা মনে করেন যে তাঁদের এই সঙ্কীর্ণতম স্বার্থ-প্ররোচিত ক্ষেত্রবৈশেষিক উদাসীনতা কেউ বুঝবে না, দেখবে না, কেননা তিনি এবং তাঁদের মতো নেতারা ছাড়া সকলেই অন্ধ, বধির এবং মূর্খ।
সাম্প্রতিক কালে পশ্চিমবঙ্গে এই বিপজ্জনক সংঘাতময় রাজনীতি তৈরির প্রধান কান্ডারি বিরোধী বিজেপির অবশ্য দায়িত্ববোধ কিংবা নৈতিকতাবোধের প্রয়োজনটিও নেই। তাঁরা আছেনই এখানে অশান্তি ও সংঘাত তৈরি করার লক্ষ্যে, ঠিক যেমন গত বিধানসভা নির্বাচনে সময় বুঝে সঙ্কীর্ণ উস্কানি দিয়ে রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে ভোটের গতিপথ পাল্টানোর চেষ্টা করেছিলেন। এখন সামনে আর একটি লোকসভা নির্বাচনের প্রস্তুতি, পশ্চিমবঙ্গ-সহ দেশের সমস্ত রাজ্যে সমাজে সমাজে আক্রমণ ও প্রতি-আক্রমণ তৈরি করে ভোটবাক্সের হিসাব শুরু হয়ে গিয়েছে। সম্প্রতি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যখন রাজ্য বিজেপি দলকে বার্তা দিলেন যে, যে করে হোক সংগঠনের শক্তি বাড়াতে হবে, তা শুনে আশঙ্কা ধাপে ধাপে বেড়ে যেতে পারে। সিঁদুরে মেঘ দেখে আতঙ্কিত নাগরিকের মনে হতেই পারে যে, নতুন তৎপরতার বার্তায় বোধ হয় উহ্য থেকে গেল এই কথাটিই, দরকারে পেশিশক্তি ও ‘বেশি’ শক্তিরও প্রয়োজন পড়তে পারে— যেমন দেখা গিয়েছে উত্তরপ্রদেশে এবং দেশের অন্যত্র। পশ্চিমবঙ্গের সমাজে যে স্বাভাবিক ঐক্যবোধ, নানা কারণে তা বিনষ্ট হয়ে চলেছে, প্রতি ভোটের আগে তা নিয়ম করে কয়েক ধাপ নীচের দিকে নামে। এই অসম্ভব কঠিন সময়ে রাজ্যের রাজনৈতিক দল ও নেতাদের পরীক্ষা— তাঁরা রাজ্যকে এই বিরাট বিপর্যয় থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছেন, না কি করছেন না। এই একটি পরীক্ষাতেই তাঁদের স্বরূপ উদ্ঘাটিত হবে। পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাস কালক্রমে তাঁদের সেই স্বরূপই লিপিবদ্ধ করবে। ইতিহাস-রচনার সেই রোজকার খাতাটিতে এই বছরের রামনবমী পর্ব গভীর কলঙ্ককালি দিয়ে মুদ্রিত হল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy