প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। —ফাইল চিত্র।
দেশে সংসদীয় সংস্কারের বান ডেকেছে। যে পরিমাণ সংস্কার যে দ্রুততায় সাধিত হচ্ছে, দেখলে মনে হয়, এই মুহূর্তে কোনও বিশেষ তাড়ায় ঝড়ের বেগে ধাবমান কেন্দ্রীয় সরকার। চলতি মাসের ১৮ থেকে ২২ তারিখ পাঁচ দিনের সংসদ অধিবেশনটি ডাকা হয়েছে রীতিমতো আকস্মিক ভাবেই। সঙ্গত জল্পনা তীক্ষ্ণমুখ হয়ে উঠছে— আকস্মিক এই তৎপরতার পিছনে নিশ্চয়ই কেন্দ্রীয় শাসক দলের অতি গুরুতর কোনও স্বার্থ আছে। সুবোধ্য ভাবেই মনে করা হচ্ছে সেই স্বার্থটি হল— ‘এক দেশ এক ভোট’ নীতি। বিষয়টি নতুন নয়। নরেন্দ্র মোদী সরকার অনেক দিন ধরেই ধুয়াটি দিয়ে রেখেছে, তবে এখন সুর চড়ানোর চেষ্টাই বলে দেয়, ধুয়ার কাজে পরিণত হওয়া কেবল সময়ের অপেক্ষা। বিরোধীদের সঙ্গে আলোচনা ইত্যাদি স্বাভাবিক ভাবেই অপ্রাসঙ্গিক। সংখ্যায় তাঁরা শাসকের সঙ্গে পাল্লা দিতে তো পারেনই না, এমনকি সংসদীয় তর্কের নামে যখন চিৎকার চেঁচামেচি অভিযোগ দোষারোপ ‘হোয়াটঅ্যাবাউটারি’ চলে, তখনও শাসকের পারদর্শিতার কাছে বাকিরা নেহাত ম্রিয়মাণ। তদুপরি, এই বিশেষ নীতিটি যে কমিটি খতিয়ে দেখবে, সেখানে মাত্র এক জন বিরোধী: বিরোধী দলনেতা কংগ্রেসের অধীররঞ্জন চৌধুরী। তিনি কমিটিতে থাকতে অস্বীকার করেছেন, কেননা তাঁর ভূমিকা ছিল আলঙ্কারিক, দেশ ও দশের চোখে ধুলো দেওয়ার ব্যবস্থা।
এক দেশ এক পরিচিতি, এক দেশ এক শিক্ষা, এক দেশ এক দেওয়ানি বিধি, এক দেশ এক ডিজিটাল লাইব্রেরি, এই সবের সঙ্গে তাল মিলিয়েই এক দেশ এক ভোটের যুক্তিটিও বাঁধা এবং সাধা হয়েছে— যদিও এ ক্ষেত্রে একটি অতিরিক্ত আর্থিক কারণকেও সামনে গুরুত্ব দিয়ে তুলে ধরার সুযোগ ঘটেছে। বারংবার ভোটের ব্যবস্থাপনায় যে বিপুল ব্যয় হয়, তা কমিয়ে আনা যাবে, এই হল সেই যুক্তি। যুক্তিটি তথ্যগত ভাবে ভুল নয়। কিন্তু প্রশ্ন হল, কোনও কোনও ক্ষেত্রে কি খরচ কমানোর নীতিটির থেকে খরচের উদ্দেশ্যটি অধিক গুরুত্বপূর্ণ নয়? তার্কিক তর্ক তুলতে পারেন, শিক্ষা খরচসাপেক্ষ বলে কি শিক্ষা তুলে দেওয়া হবে? কুতার্কিক বলতে পারেন, পুরো ভোটব্যবস্থাটাই তুলে দিলে কি খরচের ধাক্কা আরও কমানো যাবে না? গণতান্ত্রিক দেশে গণতন্ত্র রক্ষার দায়টি প্রাথমিক গুরুত্বের, যত ব্যয়ই হোক— সে কাজে ফাঁকি দিলে দেশের চরিত্রই পাল্টে যায়। খরচ কমাতে হলে বরং দিল্লির ভোল বদলের জন্য ১২৪৫০ কোটি টাকা ধার্য না করলেই হত, কিংবা জি২০ অধিবেশনে বিদেশি অভ্যাগতদের মনভোলানোর লক্ষ্যে ৪১০০ কোটির রাজসূয় না করলেই চলত।
কথাটা হল, এক দেশ এক ভোট হলে ভারত নামে গণতান্ত্রিক যুক্তরাষ্ট্রীয় দেশটির লাভ না ক্ষতি? এত বিরাট দেশে সমাজ, রাজনীতি, সাংস্কৃতিক বৈচিত্রের মধ্যে প্রাদেশিক নির্বাচনকে গৌণ করে দিলে তাতে লাভ যা-ই হোক, ক্ষতিটা যে বৈচিত্রের, বহুত্বের— শাসক দলও বিজেপিও সেটা একবাক্যে মানবে, কেননা তারা ঠিক এই বৈচিত্রধ্বংসের লক্ষ্যটিকেই সামনে রেখে এগোতে চায়। জাতীয় নির্বাচন হয় জাতীয় প্রশ্নে, আর প্রাদেশিক নির্বাচনে— প্রতি অঞ্চলের নিজের সুবিধা-অসুবিধা, সুখ-দুঃখের নিরিখে ভোট হয়। সব নির্বাচন এক সঙ্গে এক সময়ে করলে তাতে আঞ্চলিক বিষয়গুলির গুরুত্ব হারিয়ে যাবে, সন্দেহ নেই। ভারত নামক দেশটিকে যে ভাবে যুক্তরাষ্ট্রীয় করতে চাওয়া হয়েছিল, সেই দর্শন এতে অবলুপ্ত হয়ে যাবে। আর একটি কথা। এ দেশে ভোটই মানুষের মতপ্রকাশের একমাত্র অবকাশ— এই কারণেই ‘এক দেশ’ সিরিজ়ের মধ্যেই সব কয়টি ধুয়া পড়লেও বিষয় হিসাবে অন্য ধুয়া ও নীতির থেকে এটি অনেক বেশি মৌলিক ও জরুরি। সরকারের জয়রথ থামানোর ক্ষমতা কারও আছে কি না, ‘ইন্ডিয়া’ ‘ভারত’ হতে চলেছে কি না, এই মুহূর্তে জানা নেই। তবে এই নীতি পাশ হয়ে গেলে এ দেশ যে একেবারে গোড়া থেকে মূলগত ভাবে পাল্টে যাবে— প্রতি নাগরিকের এ কথা জেনে রাখা কর্তব্য।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy