Advertisement
২৫ নভেম্বর ২০২৪
Calcutta High Court

নির্লজ্জ

আইন নাগরিকের জন্য নিরাপত্তার পরিসর তৈরি করবে— এই ছিল সংবিধান প্রণেতাদের উদ্দেশ্য।

Calcutta High Court

কলকাতা হাই কোর্ট। —ফাইল চিত্র।

শেষ আপডেট: ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০৫:৫৩
Share: Save:

বিরোধীদের মিছিল-সমাবেশ আটকানোর জন্য ১৪৪ ধারা জারি করা চলে না, মনে করাতে হল কলকাতা হাই কোর্টকে। লজ্জা পাওয়ার ক্ষমতা যদি অবশিষ্ট থাকত, তা হলে এই তিরস্কারে মুখ লুকোতেন সরকারি আধিকারিকরা। কিন্তু তেমন প্রতিক্রিয়া আশা করা চলে না, কারণ শাসক দলের নির্দেশ অনুসারে কাজ করার অভ্যাসটি এত দিনে তাঁদের মজ্জায় ঢুকে গিয়েছে। এর পরেও কেবল বিজেপি, কংগ্রেস বা সিপিএম-এর কার্যসূচি রুখতে যদি ১৪৪ ধারা জারি করা হয়, তাতে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। জীবন বা সম্পদের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা, বা দাঙ্গার মতো পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার সুনির্দিষ্ট সম্ভাবনা থাকলে, তবেই জনসমাবেশ নিষিদ্ধ করার জন্য ১৪৪ ধারা প্রয়োগ করা যায়। কেন বিজেপি নেতা শুভেন্দু অধিকারীর খেজুরির সভার প্রাক্কালে ওই ধারা প্রয়োগ করা হল, আদালতে তার সদুত্তর দিতে পারেননি কাঁথির মহকুমা শাসক। বঙ্গ রাজনীতিতে এই অনিয়মই আজ প্রত্যাশিত, এই দুর্ভাগ্যজনক সত্যটি অস্বীকার করার উপায় নেই। এবং এটাও সত্য যে, এই প্রবণতার জন্ম বর্তমান আমলে নয়— বাম আমল থেকেই দেখা গিয়েছে, বিরোধীদের মিছিল-সমাবেশ পুলিশের অনুমোদন পায় না। বিরোধী রাজনৈতিক কার্যসূচিতে যোগদান যাঁরা করবেন, তাঁদেরই মাথার উপরে আইনভঙ্গের নানা ধারার খাঁড়া ঝুলবে, এটাই যেন দস্তুর হয়ে উঠেছে। কিন্তু তার বিপদ কোথায়, তা ধরিয়ে দিয়েছে আদালতই— এমন ভাবে পুলিশ দিয়ে বিরোধীদের নিয়ন্ত্রণ করে ‘পুলিশশাসিত রাজ্য’। পশ্চিমবঙ্গে আজ তারই চিহ্ন প্রকট।

এ ভাবে বিরোধী রাজনীতিকে ‘অবৈধ’ প্রতিপন্ন করার যে মানসিকতা, তা গণতন্ত্রের বিরোধী তো বটেই, সেই সঙ্গে আইনের শাসনের ধারণাকেও তা নস্যাৎ করে। সর্বজনমান্য যুক্তিই হল প্রশাসনের ভিত্তি। বিরোধী দলগুলির বক্তব্যকে ‘অযৌক্তিক’ বলে দেখাতে গিয়ে, প্রশাসনে যুক্তির প্রাধান্যকেই খর্ব করছে শাসক দল, এবং আনুগত্য-সর্বস্ব আধিকারিকরা। কাজটা যে কাণ্ডজ্ঞানহীন, শিশুসুলভ, তা স্পষ্ট করে দিয়েছে হাই কোর্ট। বিচারপতি বলেছেন, “বিরোধীদের আটকাতে এমন বাচ্চাদের মতো যুদ্ধ করা যায় না।” এতে শাসক দলের লজ্জা পাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু সে আশা বাতুলতা। নির্লজ্জ আস্ফালন, স্বার্থান্ধতা, অপরের ন্যায্য দাবিকে নস্যাৎ করা— এগুলিই আজ দলীয় রাজনীতির পরিচয় হয়ে উঠেছে। যেখানে যে দল ক্ষমতায় রয়েছে, সেখানেই তারা বিরোধীদের আঘাত করতে আইনের অন্যায় প্রয়োগ করছে। বিরোধী দলনেতা ও নাগরিক সংগঠনের নেতাদের উপর সন্ত্রাসবাদ বা রাষ্ট্রদ্রোহ প্রতিরোধের ধারা নির্বিচারে আরোপ করেছে কেন্দ্র। পশ্চিমবঙ্গে বিরোধী নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মাদক আইনের যথেচ্ছ ব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে। করোনা অতিমারির জন্য জারি করা বিশেষ আইন বারংবার ব্যবহৃত হয়েছে নাগরিক প্রতিবাদগুলিকে ছত্রভঙ্গ করতে, প্রতিবাদীদের গ্রেফতার করতে।

আইন নাগরিকের জন্য নিরাপত্তার পরিসর তৈরি করবে— এই ছিল সংবিধান প্রণেতাদের উদ্দেশ্য। কার্যক্ষেত্রে আইনের ধারাগুলি দিয়ে গেঁথে ফেলা হচ্ছে সরকারের সমালোচকদের। উদ্দেশ্য আদ্যন্ত রাজনৈতিক, কিন্তু তার দায় গ্রহণ করে না ক্ষমতাসীন দল। তৃণমূলের মুখপাত্র ভাঙড়ে, খেজুরিতে বিরোধীদের কার্যসূচি রুখতে ১৪৪ ধারা জারি করার দায় চাপিয়েছেন স্থানীয় প্রশাসনের উপর। এ ভাবেই পঞ্চায়েত নির্বাচনে অনিয়ম, নিয়োগ দুর্নীতি, কয়লা কেলেঙ্কারি, গরু পাচার থেকে মিড-ডে মিলের তহবিলে গরমিল— সব মামলায় কাঠগড়ায় উঠছেন পুলিশ-প্রশাসনের আধিকারিকরা। আর কত দিন সরকারি কর্মীরা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হবেন, আদালতে অপদস্থ হবেন এবং জনসমক্ষে হেয় হবেন? নেতার রক্তচক্ষুর ভয়ে যে আধিকারিকরা আইন-বিধি ভঙ্গ করছেন, তাঁরা আরও বড় বিভীষিকা নির্মাণে সহায়তা করছেন। নিজের জন্য, দেশবাসীর জন্যও।

অন্য বিষয়গুলি:

Calcutta High Court Section 144 West Bengal
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy