Advertisement
২৬ নভেম্বর ২০২৪
Madhyamik Examination 2023

অঙ্কে ভুল

পঠনপাঠনে ঘাটতির যে চিত্র এ বছর মাধ্যমিক পরীক্ষা উপলক্ষে সামনে এল, তার একটাই ব্যাখ্যা— শিক্ষা দফতরের ব্যর্থতা। এই ব্যর্থতার জন্য এমনকি করোনা অতিমারিকেও দায়ী করা যায় না।

picture of madhyamik.

শিক্ষার অধিকার আইন বলবৎ হওয়ার ফলে ২০১৩ সালে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তির ন্যূনতম বয়স হয়ে দাঁড়ায় ছ’বছর। প্রতীকী ছবি।

শেষ আপডেট: ০৩ মার্চ ২০২৩ ০৮:৪০
Share: Save:

এবছর মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় চার লক্ষ কমল কেন, তার ব্যাখ্যা দিলেন শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু। তাঁর মতে, শিক্ষার অধিকার আইন বলবৎ হওয়ার ফলে ২০১৩ সালে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তির ন্যূনতম বয়স হয়ে দাঁড়ায় ছ’বছর। অনুশাসন মানতে সে বছর প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছিল কম পড়ুয়া, তাই ২০২৩ সালে পরীক্ষার্থীর সংখ্যা কমেছে। তাঁর এই বক্তব্য অবশ্য উত্তর জোগানোর চেয়ে প্রশ্নই তুলল বেশি। যেমন, ২০১৩ সালে ঠিক কত ছাত্রছাত্রী ভর্তি হয়েছিল প্রথম শ্রেণিতে, তা আন্দাজের বিষয় নয়, সরকারি নথিতে সেই সংখ্যা রয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারকে রাজ্য সরকার যে তথ্য দিয়েছিল, তাতে বারো লক্ষের কিছু বেশি পড়ুয়ার হিসাব ছিল। দু’বছর পরে তৃতীয় শ্রেণিতে এদের সংখ্যা বরং কিছু বেড়েছিল। পাটিগণিতের অঙ্ক বলছে প্রায় পাঁচ লক্ষ ছাত্রছাত্রী কী করে ‘উধাও’। রাজ্য সরকার আজ যে প্রশ্ন এড়াতে চাইছে, তার উত্তর দিতে হবে আগামী বছর। বয়স পূর্ণ না হওয়ায় ২০১৩ সালে কম পড়ুয়া ভর্তি হয়ে থাকলে, অথবা দশম শ্রেণির পরীক্ষায় ‘কড়াকড়ি’-র জন্য এ বছর অনেকে অকৃতকার্য হয়ে থাকলে, আগামী বছর মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী চার-পাঁচ লক্ষ বেশি হওয়া উচিত। সে পরীক্ষায় রাজ্য সরকার পাশ করবে কি? আশা কম। সম্ভবত তখন শিক্ষা দফতর কোনও নতুন ব্যাখ্যার উদ্ভাবন করবে, অথবা বিধানসভায় ফের ‘গিলোটিন’-এ শিক্ষাকে পাঠিয়ে উত্তর দেওয়ার দায় এড়াবে।

পঠনপাঠনে ঘাটতির যে চিত্র এ বছর মাধ্যমিক পরীক্ষা উপলক্ষে সামনে এল, তার একটাই ব্যাখ্যা— শিক্ষা দফতরের ব্যর্থতা। এই ব্যর্থতার জন্য এমনকি করোনা অতিমারিকেও দায়ী করা যায় না। এ বছর ঝাড়খণ্ডে সত্তর হাজার, কেরলে তিরিশ হাজার, বিহারে পনেরো হাজার পরীক্ষার্থী বেড়েছে। কেবল পশ্চিমবঙ্গেই অতিমারির প্রকোপে চার লক্ষ পরীক্ষার্থী কমল কেন? জেলাওয়ারি চিত্রে সঙ্কটের তীব্রতা আরও স্পষ্ট হয়— বেশ কিছু জেলায় পরীক্ষার্থীর সংখ্যা গত বছরের অর্ধেক, বা তারও কম। যত ছাত্রছাত্রী রেজিস্ট্রেশন করিয়েছে, তাদেরও অনেকে পরীক্ষা দিচ্ছে না। এতে প্রস্তুতিতে ঘাটতির ইঙ্গিতই মেলে। কেন দশ বছর স্কুলে পড়াশোনার পরেও এত ছেলেমেয়ে জীবনের প্রথম পরীক্ষায় বসার আগেই নীরবে সরে যাচ্ছে? শিক্ষা দফতর দায় এড়াতে পারে না।

আসল কথা, অঙ্কেই ভুল। এবং ভুলটা রাজনীতির অঙ্কে। স্বীকার করতেই হবে, পশ্চিমবঙ্গের স্কুল-চিত্র ২০১১ সালের পর পাল্টাতে শুরু করেনি, বাম জমানাতেও পরিস্থিতি ছিল যথেষ্ট উদ্বেগজনক। তৃণমূল সরকার ক্ষমতায় আসার পর এ বিষয়ে আলাদা করে মনোযোগ দেওয়ার গুরুত্ব অনুধাবনও করেছিল। কিন্তু এই বারো বছরে কতখানি ‘উন্নতি’ হয়েছে, তা উপরের তথ্যেই স্পষ্ট। বস্তুত, গত কয়েক বছরে যেন স্কুলগুলিকে প্রধানত সরকারি প্রকল্পের দফতর হিসেবে ব্যবহার করেছে রাজ্য সরকার। পঠনপাঠন ক্রমশ ‘এলেবেলে’ হয়ে গিয়েছে। অগণিত স্কুলে শিক্ষকের সংখ্যায় বিপুল ঘাটতি, শিক্ষার প্রাথমিক পরিকাঠামো যেমন চেয়ার টেবিল ক্লাসঘরের অভাব, তার সঙ্গে অনিয়মিত ক্লাস, পাঠদানে অবহেলা— এমন নানা কারণের জন্য পড়ুয়াদের বনিয়াদি দক্ষতা তৈরি হচ্ছে না। এ সব বুঝেও এত দিন গা করেনি শিক্ষা দফতর। বরং রাজ্য সরকার স্কুলে ছাত্রছাত্রী আনতে চেয়েছে অন্য উপায়ে— পড়ুয়াদের ভাতা, মিড-ডে মিল, সবুজসাথীর সাইকেল, জামা-জুতো-ব্যাগ, নিচু ক্লাসের পরীক্ষায় ঢালাও পাশ এবং মাধ্যমিক পরীক্ষায় ঢালাও নম্বরের প্রতিশ্রুতি দিয়ে। কোনও মতে স্কুলে দশ বছর কাটালেই পাশ সার্টিফিকেট মিলবে, এমন টোপ কেউ প্রত্যাখ্যান করতে পারবে না, সম্ভবত এই ছিল নেতাদের হিসাব। কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল, লিখতে-পড়তে শেখার ক্ষমতা যাদের তৈরি হয়নি, সেই লজ্জিত, বিরক্ত শিশুরা অর্থহীন নম্বর-লেখা এক টুকরো কাগজের জন্য ক্লাসঘরে বৃথা সময় কাটাতে রাজি নয়। ওই কাগজের দামের চেয়ে তাদের সময়ের দাম বেশি।

অন্য বিষয়গুলি:

Madhyamik Examination 2023 Bratya Basu
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy