—ফাইল চিত্র।
তিনি যে দিন ‘হিন্দু-মুসলমান’ করবেন, সে দিনই সর্বজনীন জীবনে থাকার অধিকার হারাবেন, এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে কথাটি বললেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। কথাটি শোনার পর থেকে জনসমাজে যে রসিকতার বন্যা বইছে, কেউ তাতে গা ভাসিয়ে দিতে পারেন। অথবা, কেউ প্রধানমন্ত্রীর বিস্মৃতির প্রাবল্য বোঝাতে তৈরি করতে পারেন উদাহরণের তালিকা, দেখাতে যে, এই লোকসভা নির্বাচনের প্রচারপর্বেই তিনি একের পর এক জনসভায় মুসলমান-বিদ্বেষী ভাষণ দিয়েছেন। বলা যেতে পারে তাঁর দলের বিবিধ সোশ্যাল মিডিয়া হ্যান্ডল-এর কথাও, যেখানে বিদ্বেষই মূল পণ্য। কেন এই নির্বাচনে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের বিষ তাঁদের অপরিহার্য অস্ত্র হয়ে উঠেছে; কেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টামণ্ডলীকে দিয়ে নির্বাচনের মধ্যেই তৈরি করাতে হয় সম্পূর্ণ ভ্রান্ত এবং অন্যায় ‘পরিসংখ্যানগত বিশ্লেষণ’ যাতে দেখানো যায় যে, স্বাধীনতা-পরবর্তী পর্যায়ে ভারতের মোট জনসংখ্যায় মুসলমানদের অনুপাত বেড়েছে চড়া হারে, এবং হিন্দুদের অনুপাত কমেছে— এই প্রশ্নগুলির উত্তরও সন্ধান করা যেতে পারে। উত্তরগুলি অবশ্যই খুব জটিল নয়। প্রধানমন্ত্রীর পৌরোহিত্যে ভারতীয় অর্থব্যবস্থার গতিভঙ্গ হয়েছে, কর্মসংস্থানের অবস্থা করুণ, সাধারণ মানুষের দুর্দশা ক্রমবর্ধমান। দেখা যাচ্ছে, রাম মন্দিরের আবেগও যথেষ্ট কার্যকর হয়নি, সিএএ-র রাজনীতিও বিপরীত ফলদায়ী হচ্ছে। বিরোধী নেতাদের গ্রেফতার করার দমনমূলক রাজনীতিতেও তেমন কাজ হয়নি। ফলে, গৈরিক রাজনীতির পরিচিত আয়ুধ সাম্প্রদায়িকতার বিষই যে এ দফায় তাঁদের প্রধান অস্ত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে, তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই।
বরং, ভাবা প্রয়োজন, কেন প্রধানমন্ত্রী অন্তত মৌখিক ভাবে এই ভয়ঙ্কর রাজনীতির সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করতে চাইলেন? তার একটিই কারণ সম্ভব— দশ বছরব্যাপী নিরলস হিন্দুরাষ্ট্র-সাধনার পরে তিনি বুঝেছেন, ভারত নামক ধারণাটির আত্মাকে পাল্টে দেওয়া খুব সহজ কাজ নয়। জনসংখ্যার একটি অংশ সেই ঘৃণার রাজনীতিতে সক্রিয় ভাবে অংশগ্রহণ করে বটে, কিন্তু সিংহভাগ মানুষ বিশ্বাস করেন, এ দেশ সকলের, শুধু হিন্দুদের নয়। সম্প্রতি সিএসডিএস-লোকমত’এর একটি সমীক্ষায় এই তথ্যটি উঠে এসেছিল। তবে সমীক্ষার দরকার নেই, ধর্মীয় উস্কানি যে পেটের ভাতের পরিপূরক হতে পারে না, এই কথাটি মানুষ নিজের যাপিত অভিজ্ঞতায় বুঝছেন, বাতাসে কান পাতলেই তা শোনা যাচ্ছে। সম্ভবত সেই কারণেই প্রধানমন্ত্রী ‘সাবধানী’ হতে চাইছেন— জনসভায় বিস্তর ঘৃণা ছড়ালেও অন্যত্র অন্য রকম দাবি করছেন।
ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ উগ্র সাম্প্রদায়িকতাকে প্রত্যাখ্যান করছেন, এই কথায় আশাবাদী হওয়া যায়, যদিও আশাবাদের সীমা নিয়ে উদ্বেগ থাকেই। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ উদারবাদী ধর্মনিরপেক্ষতার গুরুত্ব অনুধাবন করে সহিষ্ণুতার পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করছেন, এ কথা ভাবলে নিশ্চয়ই ভাল লাগে, কিন্তু বাস্তব কতখানি ভাল লাগার মতো, তা নিয়ে সংশয় আছে। তবে অনুমান করা চলে, দেশের মানুষ বুঝেছেন যে, খালি পেটে ধর্ম হয় না— বেঁচে থাকতে হলে ধর্মের আগে অন্ন প্রয়োজন। আশা করা যায়, মানুষ এও ধরে ফেলেছেন যে, অন্নসংস্থানে ব্যর্থতাকে ঢাকার জন্যই এত সাম্প্রদায়িক আস্ফালন। এর পরেও কে কোন দিকে যাবেন, তা এক বিরাট কৌতূহলের বিষয়, হয়তো আগামী দিনের গবেষণারও বিষয়। ইতিহাস বলে, দীর্ঘ দিন ধরে মানুষকে বোকা বানানো চলে না। ভারতের মাটিতে এই কথাটি যে বিভেদ-মাতোয়ারা নেতাদেরও স্মরণ করিয়ে দেওয়া গেল, তার জন্য কৃতিত্বটি সাধারণ মানুষেরই। সাম্প্রদায়িকতার কারবারির যে দেশশাসনের অধিকার থাকে না, বাইশ বছর সাম্প্রদায়িক কার্যক্রমে নিযুক্ত থাকার পর ও দশ বছর বিভেদপন্থী প্রধানমন্ত্রী থাকার পরেও নরেন্দ্র মোদীকে দিয়ে এই কথা বলিয়ে দিতে পারলেন— ভারতীয় নাগরিক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy