প্রতীকী ছবি।
সপ্তাহান্তে দুই দিন ছুটির পর দুই দিনের ধর্মঘট— তবু, কেহ ‘অঙ্গার শতধৌতেন’ বলিয়া খেদোক্তি করিলে ব্যাঙ্ককর্মীরা চটিয়া যাইবেন। ভারতের ট্রেড ইউনিয়ন রাজনীতিতে ছুটি আর ধর্মঘট শ্যামদেশীয় যমজের ন্যায়, অবিচ্ছেদ্য। কিন্তু, তাহা গৌণ প্রশ্ন। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের কর্মীরা দেশব্যাপী দুই দিনের ধর্মঘট ডাকিলেন ব্যাঙ্কের বেসরকারিকরণের সম্ভাবনার বিরুদ্ধে। তাঁহাদের দাবিগুলিকে সরল ভাষায় অনুবাদ করিলে দাঁড়ায়: ব্যাঙ্কগুলি যতই অলাভজনক হউক, গ্রাহক পরিষেবা বস্তুটি যতই অলীক হউক না কেন, তাঁহারা সরকারি চাকুরির নিশ্চিন্ত আশ্রয়টি ছাড়িবেন না। ব্যাঙ্ক বেসরকারি হইলে পাছে উৎপাদনশীল হইয়া উঠিতে হয়! ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা একটি বাণিজ্যিক পরিষেবা প্রদান করে, ফলে লাভযোগ্যতা তাহার ধর্ম হওয়াই বিধেয়। অধিকাংশ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কই সেই ধর্ম পালনে ব্যর্থ। কেহ পাল্টা যুক্তি দিতে পারেন যে, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলিকে বহুবিধ সামাজিক দায়িত্বও পালন করিতে হয়। গ্রামাঞ্চলের মানুষদের, দরিদ্রদের ব্যাঙ্কিং পরিষেবার আওতায় আনিতে হয়; সামাজিক ভাবে গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু তুলনায় অ-লাভজনক, বিভিন্ন ঋণ বণ্টন করিতে হয়। বেসরকারি ব্যাঙ্ক কি এই দায়িত্ব পালন করিবে? প্রান্তিক গ্রাহকের জন্য দুশ্চিন্তায় ব্যাঙ্ককর্মীদের ঘুম ছুটিয়া গিয়াছে, তাঁহারা ধর্মঘট ডাকিয়াছেন, এমন কথা শুনিলে সেই মানুষগুলি হাসিয়া ফেলিবেন— কিন্তু সেই কথা থাকুক। বেসরকারি ব্যাঙ্কগুলির উপর যদি এই পরিষেবা প্রদানের দায়িত্বটি আরোপ করা হয়, তাহারা কেন করিবে না, সেই যুক্তি মেলা ভার।
কেহ প্রশ্ন করিতে পারেন, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলির অনাদায়ি ঋণের এই বোঝা কি ব্যাঙ্কগুলির অকুশলতার ফল, না কি, এই ব্যাঙ্কগুলিতে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ সহজসাধ্য বলিয়াই এই অবস্থা? উত্তরটি জানা। এক্ষণে কেহ আরও প্রশ্ন করিতে পারেন, মূলত যাঁহাদের অনাদায়ি ঋণের ফলে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলির এমন হাঁড়ির হাল হইয়াছে, বেসরকারিকরণের মাধ্যমে তাঁহারাই যদি ব্যাঙ্কগুলির মালিক হইয়া বসেন, তবে দেশের আর্থিক মূলধনের বাজারটির চেহারা কেমন দাঁড়াইবে? প্রশ্নটি উড়াইয়া দিবার মতো নহে। প্রথমত, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলির নিকট যাঁহাদের অনাদায়ি ঋণের পরিমাণ একটি নির্দিষ্ট সীমার ঊর্ধ্বে, বেসরকারিকরণের মাধ্যমে তাঁহারা যাহাতে ব্যাঙ্কের মালিক না হইতে পারেন, তাহা নিশ্চিত করা যায় কি না, সরকারকে ভাবিয়া দেখিতে হইবে। দ্বিতীয়ত, ব্যাঙ্কগুলিতে সঞ্চিত অর্থের যে ভান্ডার এই বেসরকারি মালিকানার অধীনে আসিবে, তাহার কুশলী ও উৎপাদনশীল ব্যবহার হইবে কি না, সেই প্রশ্নও উঠিতেছে। অর্থাৎ, কোনও বাণিজ্যিক সংস্থা একটি ব্যাঙ্কের মালিকানা পাইলে, সেই ব্যাঙ্কের পুঁজি লাভযোগ্যতার বিবেচনা ব্যতিরেকেই সেই সংস্থার ব্যবসায় লগ্নি করা হইবে, এমন আশঙ্কাও আছে। আশঙ্কাটি গুরুতর। এইখানেই নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণের গুরুত্ব। ব্যাঙ্কগুলি যাহাতে অর্থনৈতিক যুক্তি অনুসারেই পরিচালিত হয়, কাহাকে অন্যায় সুবিধা পাওয়াইয়া না দেওয়া হয়, তাহা নিশ্চিত করিবার দায়িত্ব সরকারের। বেসরকারি ব্যাঙ্কগুলির জন্য পরিচালন-পদ্ধতি ও অন্যান্য নিয়ম বাঁধিয়া দিতে হইবে, এবং ব্যাঙ্কগুলি যেন সেই নিয়ম মানিয়া চলে, তাহা নিশ্চিত করিতে হইবে। গোটা দুনিয়ার ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা এই ভাবেই চলে। ভারতেও চলিবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy