সাম্প্রতিক কালের মধ্যে ভয়ঙ্করতম রেল-দুর্ঘটনা ওড়িশায়। —ফাইল চিত্র।
সাম্প্রতিক কালের মধ্যে ভয়ঙ্করতম রেল-দুর্ঘটনাটি ঘটল ওড়িশায়। মৃতদের পরিবারবর্গের জন্য কোনও সান্ত্বনাই যথেষ্ট নয়। আহতদের জন্য যথাযথ চিকিৎসার ব্যবস্থা করা, তাঁদের আর্থিক সহায়তা ও পুনর্বাসন নিশ্চিত করা জরুরি। রেল মন্ত্রক জানিয়েছে, এই দুর্ঘটনা ঘটল কেন, সে বিষয়ে উচ্চপর্যায়ের তদন্ত হবে। পূর্বের অভিজ্ঞতা যদি নির্দেশক হয়, তবে অনুমান করা চলে যে, দোষী সাব্যস্ত করার জন্য চুনোপুঁটির অভাব ঘটবে না। নিশ্চয়ই খুঁজে পাওয়া যাবে এমন এক বা একাধিক রেলকর্মীকে, যাঁরা সিগন্যাল ভুল করেছিলেন, বা অন্য লাইনে ট্রেন ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন, অথবা অন্য কোনও ভয়ঙ্কর গাফিলতি করেছিলেন। তেমন দোষীদের অবশ্যই শাস্তি হওয়া জরুরি, কিন্তু সেটুকুই যথেষ্ট নয়। প্রশ্ন করা প্রয়োজন, বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম রেল নেটওয়ার্ক এমন বেহাল কেন, যেখানে কোনও ব্যক্তিবিশেষের গাফিলতির পরিণতি এমন ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনা? ২০২২ সালে ভারতীয় রেলে ‘কবচ’ ব্যবস্থা চালু হয়েছিল। রেল মন্ত্রক জানিয়েছে, এই রুটে সে ব্যবস্থা ছিল না। দুর্ঘটনাটি না ঘটলে সম্ভবত জানা যেত না, রেলমন্ত্রী-সহ কর্তারা প্রবল আত্মতুষ্ট ভঙ্গিতে যে সুরক্ষাব্যবস্থা চালু করার কথা বলেন, সেটি মূলত কথার কথাই— নাগরিকের সুরক্ষা নয়, প্রকৃত নিরাপত্তা নিশ্চিত করা নয়, সরকারপক্ষের মূল উদ্দেশ্য শুধু কথা গেঁথে-গেঁথে করতালি অর্জন করা। সরকারের তরফে কেউ এখনও এই দুর্ঘটনাটির দায় স্বীকার করেননি। গত কয়েক বছরের অভিজ্ঞতা বলবে যে, সেই সম্ভাবনা অতি ক্ষীণ। হাততালিতেই সবার আগ্রহ, দায় স্বীকারের সাহস বিরল। এবং, দায় অস্বীকার করাই যদি মূল উদ্দেশ্য হয়, তা হলে যা হওয়ার, আশঙ্কা হয় যে এই ক্ষেত্রেও তা-ই হবে— চুনোপুঁটিদের সামনে ঠেলে রাঘববোয়ালরা গা-ঢাকা দেবেন। ‘ভারত কা কবচ’ শীর্ষক বিজ্ঞাপনে মুখ ছিল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর। সেই কবচ এতগুলি প্রাণকে রক্ষা করতে পারল না, সেই দায় কার?
যেখানে প্রধানমন্ত্রী একের পর এক বন্দে ভারত এক্সপ্রেস চালু করছেন, দেশবাসীকে বুলেট ট্রেনের খোয়াব দেখাচ্ছেন, সেখানে এই দুর্ঘটনা এক গভীর সঙ্কটের বার্তা বহন করে। আশঙ্কা হয়, দেশের অভিভাবকদের কাছে বহিরঙ্গের চাকচিক্যই গুরুত্বপূর্ণ— ট্রেনের ভিতরে এলইডি স্ক্রিনে প্রধানমন্ত্রীর সহাস্যবদনটি দেখা যাওয়া যতখানি জরুরি, যাত্রীদের নিরাপত্তার গুরুত্ব তার কণামাত্র নয়। ঘটনা হল, ভারতীয় রেলের পরিকাঠামোগত উন্নতির জন্য যে লগ্নি প্রয়োজন, তার অংশমাত্রও জোটে না। বন্দে ভারত এক্সপ্রেস চালু হওয়ার সময়ও প্রশ্ন উঠেছিল, এমন অত্যাধুনিক ট্রেন চালানোর জন্য যেমন লাইন প্রয়োজন, তারই যদি ব্যবস্থা না হয়, তা হলে আর ট্রেন চালু করে লাভ কী? বহু রেলসেতু ভগ্নস্বাস্থ্য, বহু জায়গায় লাইন পাল্টানো প্রয়োজন, এখনও বহু লেভেলক্রসিং স্বয়ংচালিত নয়। কর্মীর অভাবও বিপুল। বহিরঙ্গের চাকচিক্যের দিকে নজর দিতে গিয়ে অতি জরুরি নিরাপত্তাব্যবস্থাকে কতখানি অবহেলা করা হচ্ছে, তার হিসাব নেওয়া প্রয়োজন।
ওড়িশার রেল-দুর্ঘটনার পরে এই প্রশ্নগুলি ওঠা স্বাভাবিক। সরকারের বহু বিজ্ঞাপিত কবচব্যবস্থার অধীনে রয়েছে গোটা দেশে মাত্র দুই শতাংশ রেলপথ। কেন, সেই প্রশ্নের উত্তর সন্ধান করলে নিশ্চিত ভাবেই অর্থাভাবের কথা আসবে। অর্থাৎ, বিলাসিতা করার সামর্থ্য ভারতীয় রেলের নেই, এমনকি প্রধানমন্ত্রীর শখ পূরণের জন্যও নয়। কিন্তু, তার পরও সরকার বারে বারেই সেই পথে হাঁটে কেন? তার কারণ, চাকচিক্য চোখ ধাঁধিয়ে দিতে পারে, নিরাপত্তা ব্যবস্থার সেই দ্যুতি নেই। বিজেপির উন্নয়নের ভাষ্যটিকে বিনির্মাণ করলে দেখা যাবে, তার অভিমুখ সেই চাকচিক্যের দিকেই— ভিতরে যা-ই থাক না কেন, মোড়কটি যাতে উন্নত বিশ্বের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে, তা নিশ্চিত করা। রেলের উচ্চপর্যায়ের তদন্ত এই অন্তঃসারশূন্য চাকচিক্যের প্রতি মোহের দিকে অঙ্গুলি-নির্দেশ করতে পারবে কি?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy