আবোল তাবোল-এর ‘নোট বই’ হিসাব রাখত, ‘ফড়িঙের ক’টা ঠ্যাং, আরশুলা কি কি খায়।’ বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার বিরুদ্ধে দিল্লির আনা ভূরি ভূরি অভিযোগের রকম দেখে সন্দেহ হয়, তাদের হিসাব নিয়েও ভারতীয় সরকারের এমনই ধারণা। তা না হলে ভারতের কোভিড-মৃত্যুর সংখ্যা তারা কেন এত বেশি করে দেখায়? সুতরাং, উপর্যুপরি পাঁচটি ভার্চুয়াল মিটিং এবং হু-কে লেখা ছয়টি চিঠিতে উৎক্ষেপিত হয়েছে প্রবল প্রতিবাদ— বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কোভিড গণনার পদ্ধতি বিষয়ে। আমেরিকার প্রথম সারির সংবাদপত্রে রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সঙ্গে ভারতের নিজস্ব হিসাবের বিপুল গরমিল দেখিয়ে। গরমিলটি ঠিক কী ধরনের? হু-এর হিসাবে ভারতে কোভিড-১৯ সংক্রান্ত মৃত্যু সংখ্যা চল্লিশ লক্ষ, যেখানে ভারতীয় সরকারি মতে সেই সংখ্যা পাঁচ লক্ষ একুশ হাজার। স্বভাবতই দিল্লি সরকার ক্ষুব্ধ, ক্রুদ্ধ, এমনকি ক্ষিপ্ত হয়ে পড়েছে এই ঘটনায়। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের মুখপাত্র বলেছেন, ভারতের বাস্তব অন্য দেশের বাস্তবের থেকে আলাদা, কিন্তু সেই পার্থক্যকে মাথায় না রেখে এক সাধারণ পদ্ধতিতে সব দেশের সঙ্গে ভারতকে ঢুকিয়ে দেওয়াতেই এই বিপত্তি। দাবি, অন্য বহু উন্নত দেশের তুলনায় ভারতের কোভিড-সংগ্রাম অনেক সফল, মৃতের হার অনেক কম, এবং এই সাফল্যের কোনও প্রতিচ্ছবি হু-এর রিপোর্টে অনুপস্থিত: ভারতের পক্ষে এ এক চূড়ান্ত অসম্মান।
দিনকাল যে রকম, এই শেষ বাক্যটিতে এসে পৌঁছলে আর সব যুক্তিবুদ্ধি গোল পাকিয়ে থেকে যায় কেবল এক আকাশ-অন্ধ-করা জাতীয়তাবাদের ভাবাবেগ। নিশ্চিত যে, বেশি কিছু না জেনেই ভারতের প্রতি হু-এর অবিচার নিয়ে দেশময় সংবাদমাধ্যম এবং সমাজমাধ্যম সরব হয়ে উঠবে। তবু কয়েকটি কথা এই প্রসঙ্গে স্মরণের অবকাশ আছে। ভারতের স্বাস্থ্য মন্ত্রকের বক্তব্যে একটি যুক্তিগ্রাহ্য দিক: উন্নত দেশের সঙ্গে নানা ক্ষেত্রে অনুন্নত দরিদ্র দেশের তুলনা হয় না, বাস্তব পরিস্থিতি এতই আলাদা। তেমনই আবার, এতেও সন্দেহ নেই যে, ভারত চিরাচরিত ভাবে তথ্য সংগ্রহের কাজে পিছিয়ে, এবং অন্য বহু দরিদ্র দেশের তুলনায়ও অত্যন্ত অসতর্ক, অগোছালো। কিছু সমস্যা সর্বজনবিদিত হওয়া সত্ত্বেও তার নিরাময়ের ব্যবস্থা হয় না, বিশেষত যেখানে রাজনৈতিক কারণেই বিশদ ও যথার্থ তথ্য সংগ্রহ বিপজ্জনক হতে পারে। কোভিডের দ্বিতীয় দফায় দেশে যে ঘটনা ঘটেছে, তার তথ্যনিষ্ঠ বিবরণ ও রিপোর্ট নিশ্চয়ই সরকারের মুখোজ্জ্বল করবে না, সুতরাং তথ্যে নিষ্ঠাবান হওয়ার প্রচেষ্টাও সরকারের তরফে আশা করা যায় না। কেন্দ্র, রাজ্য, কোনও সরকারের তরফেই নয়। কোভিড পর্বের গোড়া থেকেই বিষয়টি স্পষ্ট। বহু রাজ্য সঠিক তথ্য সরবরাহ করতে অনিচ্ছুক, এবং কেন্দ্র বহু তথ্য প্রকাশ না করতে অতীব আগ্রহী। মাঝখান থেকে সত্য কেবলই লুকিয়ে যায়— তথ্যহীনতার ঘোর আঁধারে।
ভারতের নিজস্ব বাস্তবের বিশিষ্টতার মধ্যে একটি হল, আঞ্চলিক বৈষম্য। কেরল বা তামিলনাড়ুতে যে ভাবে তথ্য সংগ্রহ করা হয়, এমনকি উত্তর-পূর্বে কিছু রাজ্যেও যেমন মিজোরাম— বিহার, উত্তরপ্রদেশ, ঝাড়খণ্ড স্বীকৃত ভাবেই তার থেকে বহু যোজন দূরে। এখনও পর্যন্ত যোগী আদিত্যনাথের সরকার স্বীকার করে না, দ্বিতীয় ঢেউয়ে সে রাজ্যের মৃত্যুবিভীষিকা কোন পর্যায়ে পৌঁছেছিল। পশ্চিমবঙ্গের বিরুদ্ধেও তথ্য অপ্রকাশের লাগাতার অভিযোগ উঠেছে, বিশেষ করে কোমর্বিডিটি মৃত্যু-সংক্রান্ত তথ্য, এবং রাজ্য সরকারের ব্যাখ্যা বিশেষ সন্তোষজনক হয়ে ওঠেনি। সব মিলিয়ে যে ছবিটি ফুটে ওঠে, তা মোটেই বিজ্ঞানভিত্তিক তথ্যসম্বলিত বাস্তব চিত্র নয়। ফলে অন্যের প্রতি ক্রুদ্ধ পত্র ক্ষেপণের আগে নিজের নথি-ভান্ডারটি পরীক্ষা করলে মন্দ হয় না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy